১৬ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার
৩১শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম সভা আজ

শেয়ার করুন

রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হবে আজ শনিবার। বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে বক্তব্য রাখবেন।

গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছে। এ জন্য গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশন এরই মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তবে সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এ অবস্থায় সব পক্ষের ঐকমত্যের মধ্য দিয়ে সংস্কার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছে সরকার।

গত বুধবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন-সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজকে এই কমিশনের সহসভাপতি করা হয়েছে। কমিশনের সদস্য হিসেবে রয়েছেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনপ্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফররাজ হোসেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি এমদাদুল হক এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করবে। এই কমিশন আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে এবং এ মর্মে পদক্ষেপ সুপারিশ করবে এ কমিশন। কমিশনের মেয়াদ হবে কার্যক্রম শুরুর তারিখ থেকে ৬ মাস।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বলেন, ঐকমত্যে পৌঁছাতে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। সেই কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর উদ্যোগ নেবে।

জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করবে। এ জন্য নবগঠিত এ কমিশন বিষয়ে আলোচনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকারের তরফে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

সূত্র বলছে, রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ বৈঠকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দল, জাতীয় নাগরিক কমিটি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও অংশ নেবেন। এই বৈঠকের পর দলগুলোর সঙ্গে আলাদা বৈঠক হবে বলেও জানিয়েছে সূত্র।

বৈঠকে অংশ নেওয়ার আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিষয়ে নিজ দলের ভাবনার কথা জানিয়েছেন বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। যদিও এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেননি কেউই। তাঁরা বলেছেন, শনিবারের বৈঠকেই জানা যাবে এই উদ্যোগের কারণ এবং এ নিয়ে সরকারের মনোভাব।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, এখনই বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে এ কমিশন গঠনের বিষয়ে বিএনপির এই নেতার অভিমত হলো, ‘যত উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন, মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফেরাতে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচিত সরকার ছাড়া দেশে স্বস্তি ফিরবে না। এজন্য নির্বাচন অনুষ্ঠান এখন সময়ের দাবি। জামায়াত ছাড়া সবাই এখন নির্বাচন চাচ্ছে। গত ৬ মাসেও মানুষের মধ্যে স্বস্তি আসেনি। নির্বাচন না হলে আগামী এক বছরেও স্বস্তি ফিরবে না।’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিষয়ে বিএনপির এই নেতার সুরেই কথা বলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, যে কমিশন গঠিত হয়েছে, বিস্তারিত না দেখে কিছু বলা যায় না। নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার দরকার, সেগুলো করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করার জন্য যা যা দরকার, ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা করে নির্বাচনের দিকে যাওয়াটাই প্রধান কাজ হবে।

পটপরিবর্তনের আগে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে এক বিন্দুতে থাকলেও এরই মধ্যে নির্বাচন ও সংস্কারসহ নানা বিষয়ে বিভাজন দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে। নির্বাচন ও সংস্কার বিষয়ে বড় দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এ মুহূর্তে দুই মেরুতে অবস্থান করছে। ন্যূনতম সংস্কার শেষ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চায় বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছে জামায়াতসহ আরও বেশ কয়েকটি দল।

গতকাল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘সংস্কার ছাড়া জাতীয় নির্বাচন করা যাবে না। নির্বাচন করার জন্য যে সংস্কার লাগে, সেটুকুর জন্য জামায়াতে ইসলামী সময় দিতে প্রস্তুত।’ এমনকি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষেও নিজেদের অবস্থানের কথা জানিয়েছে দলটি।

এদিন গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান রাজনৈতিক বিবেচনায় দেশকে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার একটা পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। যত দ্রুত জাতীয় নির্বাচন হবে, ততই রাজনীতি সহজ হবে, বাংলাদেশের মানুষ স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে আসবে।’

বিএনপি-জামায়াত ও তাদের মিত্রদের এমন বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্যের উদ্যোগ কতটুকু সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও নির্বাচনের আগে ঐকমত্য গঠনের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, ‘সংস্কার হোক, সেটা জাতি চায়। যারা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে তারাও চায়, রাজনৈতিক দলগুলোও চায়। সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সংস্কার হওয়া উচিত। এতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিষয়ে জামায়াতের ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে দলটির কেন্দ্রীয় প্রচারবিষয়ক সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘কমিশনের একটা বৈঠক আছে। সেখানে আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ওই বৈঠকে যাওয়ার পরই আমরা বুঝতে পারব, সরকার এই কমিশনের মধ্য দিয়ে কী করতে চায়, তার টার্মস অব রেফারেন্স কী, কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁরা কাজ করবেন, ঐকমত্য কীভাবে গঠন করবেন—এরপর আমরা বিস্তারিত বক্তব্য দেব।’

কমিশন বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আলোচনা শুরু হতেই হবে। এখন এটা কী রকম করে এগোয়, কোন পদ্ধতিতে, কী কী বিষয়ে, দু-একটা তো বিষয় নয়, ১৩টি কমিশন, এর মধ্যে ৬টির রিপোর্ট তৈরি আছে। এসব নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতে হবে, তারপর বোঝা যাবে। তাদের প্রস্তাবনাগুলো কী, তা দেখতে হবে। আগে থেকে কিছু বলা যাবে না।’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠককে ইতিবাচক বলে মনে করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেন, ‘সংস্কারের বিষয়ে আমাদের কমন পজিশন আছে, যা আমরা বলে আসছি। এর বাইরেও কিছু ইস্যু আছে, যা নিয়ে মানুষ আলোচনা করছে। সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করব। আলোচনার পর যেসব বিষয়ে ন্যূনতম ঐকমত্যের জায়গা যেখানে হবে, আলাপ-আলোচনার পর বুঝতে পারব।’

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের এমন বৈঠকের সূচনা ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম। তিনি বলেন, ‘কিছু ত্রুটিবিচ্যুতির পরও এটাকে আমরা ইতিবাচক মনে করি। তবে আগে তাদের (সরকার) কথা শুনতে হবে, তাঁরা কী আলাপ করেন। পরে আমরা নিজেরা বসে ঠিক করব, কী বলতে হবে। আমরা মনে করি, এই আলোচনা আরও আগে থেকেই শুরু হওয়া দরকার ছিল। দলিল ছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করা দরকার ছিল।’
…..

শেয়ার করুন