
চলতি বছরের ১০ জুলাই রাজধানীর একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ব্লাড ব্যাংক থেকে তিন ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করেন এক রোগীর স্বজন। রক্তগুলো মহাখালীর একটি সরকারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি এক মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। কিন্তু পরে দেখা যায়, স্ক্রিনিং করা রক্তের এক দাতার এইচআইভি পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে। এই ঘটনায় দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দায় নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছে, যা দেশের রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যবস্থার গভীর সংকটকেই সামনে এনেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের মতো সংবেদনশীল সেবা এখন অনিরাপদ পদ্ধতিতে চলছে। নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন অনুযায়ী, প্রতিটি রক্ত ইউনিটে ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি ও এইচআইভি—এই পাঁচটি সংক্রামক রোগ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ও আইনি জটিলতায় হাসপাতালগুলোর পক্ষে সব পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কোথাও তিনটি, কোথাও মাত্র দুটি পরীক্ষা করে রক্ত সরবরাহ করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বছরে প্রায় সাড়ে নয় লাখ ব্যাগ রক্ত পরিসঞ্চালন হয়—মানে প্রতিদিন প্রায় ২,৬০০ ব্যাগ রক্ত ব্যবহার হয়। এ রক্ত যদি যথাযথভাবে স্ক্রিনিং না হয়, তবে রোগীরা নতুন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এতে হেপাটাইটিস ও এইচআইভির মতো নিয়ন্ত্রিত রোগ পুনরায় বিস্তারের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনেও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সরকারি হাসপাতালে বর্তমানে স্ক্রিনিং ফি ৩৫০ টাকা, যার মধ্যে মাত্র ৪৫ শতাংশ—অর্থাৎ ১৭৫ টাকা—রি-এজেন্ট ও সরঞ্জাম কেনার জন্য ব্যবহার করা যায়। এতে ভ্যাট-ট্যাক্স কেটে গেলে কার্যত তিনটির বেশি পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। ফলে অধিকাংশ হাসপাতালে ম্যালেরিয়া ও হেপাটাইটিস-সি পরীক্ষা বাদ পড়ে যাচ্ছে। ভয়াবহ বিষয় হলো, অনেক হাসপাতাল এসব পরীক্ষা না করেও রিপোর্টে ‘নেগেটিভ’ ফলাফল দেখাচ্ছে।
একজন পরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ জানান, আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেই পরীক্ষার সব কিট ও রি-এজেন্ট সরবরাহ করা হতো। কিন্তু গত বছরের আগস্টের পর থেকে আর সরবরাহ করা হয়নি। বড় হাসপাতালগুলো কিছুটা টিকতে পারলেও ছোট মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতালগুলো মারাত্মক সংকটে পড়েছে। এতে সিফিলিসের মতো রোগও আবার শনাক্ত হচ্ছে, যা আগে প্রায় নির্মূল হয়েছিল।
রক্ত পরিসঞ্চালন আইন-২০০৮ অনুযায়ী, সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষ রক্ত পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কিট, রি-এজেন্ট ও সরঞ্জাম সরবরাহ নিশ্চিত করবে। কিন্তু বাস্তবে এই আইন কার্যকর হচ্ছে না। হাসপাতালগুলো জরুরি প্রয়োজনে খুব সীমিত বাজেট—সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা—থেকে কিট কেনে, যা দিয়ে দীর্ঘ সময়ের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, “রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে পাঁচটি সংক্রামক রোগের পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। তা না হলে সংক্রমণ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে এবং পরিণতি হবে ভয়াবহ।” তিনি এ ক্ষেত্রে সরকারি অবহেলার দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, বাতিল হওয়া এইচএসএম অপারেশনাল প্ল্যানের অধীনেই সারা দেশের ২০৭টি ব্লাড সেন্টারে নজরদারি, রিপোর্ট যাচাই ও কিট সরবরাহ করা হতো। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই সংকট শুরু হয়েছে।
নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. আসাদুল ইসলাম বলেন, “ওপি বন্ধের পর থেকে সেইফ ব্লাড প্রোগ্রামও কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। সিএমএসডিতেও এখন কোনো কিট বা ব্লাডব্যাগ মজুত নেই।” তিনি বলেন, “এই অবস্থায় হেপাটাইটিস-বি/সি ও এইচআইভির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।”
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর জানান, বিষয়টি তার জানা নেই, তবে খোঁজ নিয়ে দেখবেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সাইদুর রহমান দাবি করেন, বড় হাসপাতালগুলোতে বর্তমানে কোনো কিট সংকট নেই, তবে ভবিষ্যতে যাতে সমস্যা না হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হবে।
তবে মাঠপর্যায়ের হাসপাতালগুলো জানাচ্ছে, অনেক জায়গায় দুই মাসেরও কম রি-এজেন্ট মজুত আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যবস্থাই হয়ে উঠবে দেশের সংক্রমণ বিস্তারের প্রধান উৎস।
সিএনআই/২৫