১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার
১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জুলাই সনদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে যা বলা হয়েছে

শেয়ার করুন

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) বেলা ১২টার পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের উপস্থিতিতে কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে এই সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেয়।

সরকারের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে শেষ হলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আট মাসব্যাপী ধারাবাহিক কর্মযজ্ঞ।

জুলাই জাতীয় সনদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কী বলা হয়েছে তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা: সংবিধান সংশোধন করে নিম্নরূপ বিধান সংযুক্ত করা হবে-

(১) মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

(২) সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮খ সংশোধনপূর্বক সংসদের মেয়াদ অবসান হওয়ার ১৫ দিন আগে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।

(৩) মেয়াদ অবসানের ক্ষেত্রে সংসদের মেয়াদ অবসান হওয়ার ৩০ দিন আগে আইনসভার নিম্নকক্ষের স্পিকারের তত্ত্বাবধানে এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায়- (১) প্রধানমন্ত্রী, (২) বিরোধীদলীয় নেতা, (৩) স্পিকার, (৪) ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) এবং (৫) সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি- (যদি সংসদে আসন সংখ্যার বিবেচনায় একাধিক দল দ্বিতীয় বৃহত্তমবিরোধী দলের অবস্থানে থাকে তাহলে সেসব দলের মধ্য থেকে নির্বাচনে সর্বোচ্চ পরিমাণে ভোটপ্রাপ্ত দলটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হবে) মোট ৫ সদস্য সমন্বয়ে একটি ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি’ গঠিত হবে। কমিটির যেকোনো বৈঠক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জাতীয় সংসদের স্পিকার সভাপতিত্ব করবেন।

(৪) কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলো এবং জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের কাছ থেকে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮গ(৭)-এ বর্ণিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির নাম প্রস্তাবের আহ্বান করবে এবং এক্ষেত্রে প্রতিটি দল একজন এবং একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য একজন মাত্র ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে পারবেন।

(৫) রাজনৈতিক দলগুলো এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে তাদের প্রস্তাবিত নাম দাখিল করবে। কমিটি নিজ উদ‌্যোগেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদের জন‌্য উপযুক্ত ব‌্যক্তির নাম অনুসন্ধান ও অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।

(৬) পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কমিটির সদস্যরা সভায় মিলিত হয়ে নিজেদের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত এবং রাজনৈতিক দলগুলো ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে প্রস্তাবিত নামগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করত বাংলাদেশের যেসব নাগরিক সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮গ(৭)-এর অধীনে উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্য তাদের মধ্য হতে একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নেবেন এবং তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন।

(৭) বাছাই কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী ১২০ ঘণ্টার মধ্যে এ পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কোনো ব্যক্তিকে চূড়ান্ত করা সম্ভব না হলে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা পদের জন্য অনুচ্ছেদ ৫৮গ-এ বর্ণিত শর্ত অনুসরণপূর্বক সংসদের সরকারি দল/জোট ৫ জন উপযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে এবং প্রধান বিরোধী দল/জোট ৫ জন উপযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে। এছাড়া, সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল ২ জন উপযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে। যদি সংসদে আসন সংখ্যার বিবেচনায় একাধিক দল দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের অবস্থানে থাকে তাহলে সেসব দলের মধ্যে নির্বাচনে সর্বোচ্চ পরিমাণ ভোটপ্রাপ্ত দলটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হবে। উপর্যুক্ত প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত নামগুলো স্পিকার জনসাধারণের অবগতির জন্য প্রকাশ করবেন।

(৮) উপর্যুক্ত দফা (৭)-এ বর্ণিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকারি দল/জোটের প্রস্তাবিত ৫ জন ব্যক্তির নামের তালিকা হতে প্রধান বিরোধী দল/জোট যেকোনো একজনকে বেছে নেবে; অনুরূপভাবে প্রধান বিরোধী দল প্রস্তাবিত ৫ জন ব্যক্তির নামের তালিকা থেকে সরকারি দল যেকোনো একজনকে বেছে নেবে। দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের প্রস্তাবিত মোট ২ জনের নামের তালিকা থেকে সরকারি দল/জোট যেকোনো একজনকে বেছে নেবে এবং প্রধান বিরোধী দল/জোট যেকোনো একজনকে বেছে নেবে। এই পদ্ধতিতে প্রাপ্ত নামগুলোর মধ্য থেকে যেকোনো একজনের ব্যাপারে যদি প্রস্তাবকারী দলগুলোর মধ‌্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তিনিই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত হবেন। অথবা কোনো একজনের ব্যাপারে কমিটির ৫ জন সদস্যের মধ্যে যদি ৪ জন সদস্য একমত হন তাহলে তিনিই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত হবেন।

(৯) যদি উপর্যুক্ত পদ্ধতিতে কোনো একজনের বিষয়ে প্রস্তাবকারী পক্ষগুলো একমত হতে না পারে তাহলে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচার বিভাগের দুইজন প্রতিনিধি বাছাই কমিটিতে সদস্য হিসেবে যুক্ত হবেন; তবে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কারও নাম প্রস্তাব করতে পারবেন না। উক্ত দুইজন প্রতিনিধির মধ্যে একজন আপিল বিভাগের বিচারপতি হবেন এবং একজন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হবেন। উক্ত দুইজন বিচার বিভাগীয় প্রতিনিধিকে মনোনীত করার জন্য- (১) সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, (২) কর্মরত প্রধান বিচারপতি এবং (৩) আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি সমন্বয়ে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হবে।

(১০) এই পর্যায়ে ৭ সদস্যবিশিষ্ট উক্ত বাছাই কমিটির সদস্যরা পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্পিকারের তত্ত্বাবধানে গোপন ব্যালটে ‘র‌্যাংকড চয়েজ’ (Ranked Choice) বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে উক্ত সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে যেকোনো একজনকে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নেবেন।

(১১) উপর্যুক্ত যেকোনো পদ্ধতিতে মনোনীত ব্যক্তিকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতি পরবর্তী ৯০ দিনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেবেন; তবে শর্ত থাকে যে, সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় তিনি শপথ গ্রহণ করবেন না।

(১২) উপর্যুক্ত পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমেও যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বেছে নেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুসরণ করতে হবে; তবে শর্ত থাকে যে, এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বেছে নেওয়া যাবে না।

(১৩) কোনো কারণে প্রধান উপদেষ্টার পদ শূন্য হলে রাষ্ট্রপতি অবিলম্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য পূর্ববর্তী র‌্যাংকড চয়েজ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেবেন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তি দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মতি জানালে অথবা দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে র‌্যাংকড চয়েজ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতিতে পরবর্তী স্থানে থাকা ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য নিযুক্ত হবেন। এই পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা পদে পরিবর্তন হলেও উপদেষ্টা পরিষদ বহাল থাকবে। তবে উপদেষ্টা পরিষদের কোনো পদ শূন্য হলে নবনিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টা সেই শূন্য পদ পূরণের অধিকার রাখবেন।

(১৪) নিয়োগলাভের পর প্রধান উপদেষ্টা উপর্যুক্ত বাছাই কমিটির সঙ্গে পরামর্শক্রমে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮গ(৭)-এ বর্ণিত উপযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে অনধিক ১৫ জনকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের জন্য বেছে নেবেন এবং রাষ্ট্রপতি তাদের নিয়োগ দেবেন।

(১৫) মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে, ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় বিলুপ্ত সংসদের একই ধরনের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি’ গঠিত হবে এবং উক্ত কমিটি পরবর্তী ১৪ দিন তথা ৩৩৬ ঘণ্টার মধ্যে উক্তরূপ অভিন্ন পদ্ধতিতে একজন ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নেবে এবং তিনি অবিলম্বে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হবেন।

(১৬) সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮গ(৭)(ঘ) সংশোধনপূর্বক ‘বাহাত্তর বৎসরের অধিক বয়স্ক নহেন’ শব্দগুলো পরিবর্তে ‘পঁচাত্তর বৎসরের অধিক বয়স্ক নহেন’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে।

(১৭) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন এবং উপদেষ্টারা মন্ত্রীর পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।

(১৮) সংবিধানে বর্ণিত বিধানাবলি সাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব, কর্তব্য, এখতিয়ার ও অবসানের সময়সীমা নির্ধারিত হবে।

(১৯) নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হবে অনধিক ৯০ দিন। তবে দৈব-দুর্বিপাকের কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আরও সর্বোচ্চ ৩০ দিন দায়িত্ব পালন করতে পারবে।

(২০) নতুন সংসদ গঠিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী যে তারিখে তার পদের কার্যভার গ্রহণ করবেন সেই তারিখে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হবে।

(২১) ত্রয়োদশ সংশোধনীর অনুচ্ছেদ ৫৮গ(২)-এর বিধানে উল্লিখিত ব্যবস্থা বহাল থাকবে।

শেয়ার করুন