১৬ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার
৩১শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.) এর অনন্য দৃষ্টান্ত

শেয়ার করুন

ইনসাফভিত্তিক সমাজ : নবীজির (সা.) আদর্শ ও শিক্ষা

অন্যায়-অবিচার ছড়িয়ে পড়লে ইনসাফভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাই মানবতার অপরিহার্য আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সর্বোত্তম উদাহরণ হলেন বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত, নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

তিনি ছিলেন ন্যায় ও ইনসাফের জীবন্ত প্রতীক। আল্লাহ তায়ালা তাকে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি এমন এক সমাজে আগমন করেছিলেন, যেখানে সাম্য ও ন্যায়বিচারের কোনো স্থান ছিল না। শক্তিশালী দুর্বলকে চূর্ণ করে দিত, ধনীরা দরিদ্রদের ওপর নির্যাতন চালাত, কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, গোত্রীয় অহংকারের কারণে রক্তক্ষয়ী সংঘাত লেগেই থাকত। সেই বর্বর যুগে তিনি আলোর মশাল হাতে সমাজকে আলোকিত করেছেন এবং ন্যায়বিচার ও ইনসাফভিত্তিক মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

নবীজির (সা.) জীবনে ইনসাফের অনন্য দৃষ্টান্ত

১. অপরাধের ক্ষেত্রে পক্ষপাতহীন ন্যায়বিচার

মাখজুম গোত্রের এক নারী মক্কা বিজয়ের সময় চুরি করেছিল। কুরাইশরা বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে নবীজি (সা.)-এর প্রিয় সাহাবি উসামা ইবন যায়েদ (রা.)-এর মাধ্যমে সুপারিশ করলেন, যাতে ওই নারীর শাস্তি লঘু করা হয়। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তরে বললেন—

“আল্লাহর শপথ! আমার কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করত, তবে আমি তার হাত কেটে ফেলতাম।”
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৭৮৮)

এই ঘোষণা শুধু একটি বিচারের জন্য ছিল না; বরং এটি সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্পের প্রকাশ।

২. দাস-দাসীদের প্রতি সুবিচার

নবীজির (সা.) কাছে ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচুর কোনো পার্থক্য ছিল না। একবার এক ব্যক্তি তার দাসকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করছিল। তখন নবীজি (সা.) বললেন—

“এই দাসও তোমার মতো একজন মানুষ। আল্লাহ যেমন তোমার ওপর কর্তৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি তারও তোমার ওপর কিছু অধিকার রয়েছে। তুমি যা খাও, তাকেও তা খেতে দাও; তুমি যা পরো, তাকেও তা পরতে দাও। কারণ, সে তোমার অধীনস্থ হলেও আল্লাহর দৃষ্টিতে সে তোমার সমান।”
(আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৪৪)

৩. অমুসলিমদের প্রতি ন্যায়বিচার

ইনসাফ কেবল মুসলমানদের জন্য নয়, বরং সকল মানুষের জন্য সমান। একবার এক ইহুদি ও এক মুসলমানের মধ্যে সম্পদ সংক্রান্ত বিরোধ দেখা দিল। ইহুদির অভিযোগ ছিল, মুসলমান ব্যক্তি তার সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। নবীজি (সা.) সত্যতা যাচাই করে দেখলেন, ইহুদির দাবি সঠিক। তাই তিনি মুসলমানের বিরুদ্ধে রায় দিলেন।

এ ঘটনায় মুসলমান ব্যক্তি ক্ষুব্ধ হলে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে নির্দেশ দিলেন—

“কোনো জাতির প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের ইনসাফহীন না করে তোলে। ইনসাফ করো, এটি তাকওয়ার কাছাকাছি।”
(সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৮)

৪. রাষ্ট্র পরিচালনায় ইনসাফ

মদীনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর নবীজি (সা.) সর্বপ্রথম ইনসাফভিত্তিক শাসনব্যবস্থা চালু করেন। তিনি মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্য সমান ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে “মদীনা সনদ” প্রণয়ন করেন। এটি ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান, যেখানে ইনসাফকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়।

ইনসাফ শুধু আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় না; এটি গড়ে তুলতে হয় হৃদয়ের গভীর থেকে। নবীজি (সা.) শুধু আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন ও রাষ্ট্রপরিচালনায় ইনসাফের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যদি আমরা তার জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি, তবে সমাজে সত্যিকারের ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

 

শেয়ার করুন