
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিশ্চিত না হলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়—এটি অতীতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও স্পষ্টভাবে দেখা গেছে। তিনি উল্লেখ করেন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণগত মান উন্নত রাখা জরুরি। তবে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সাধারণত সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে চাপ আসলেই সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
তিনি উদাহরণ হিসেবে রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর ক্রেতাদের চাপে দেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ উন্নয়নের বিষয়টি তুলে ধরেন।
শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত অর্থনীতিবিদ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে তিনি এসব কথা বলেন।
বহুপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্যের গুরুত্ব
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বহুপক্ষীয় বাণিজ্যের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) এখন অনেকটা পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। তবে, যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পর চীন এখনো ডব্লিউটিও-তে আশ্রয় নিচ্ছে, যা এর কার্যকারিতার ইঙ্গিত দেয়।
এ ছাড়া উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উচিত সুদূরপ্রসারী ও বাস্তবসম্মত বাণিজ্য কৌশল গ্রহণ করা।
প্রধান আলোচক ও মূল প্রবন্ধ
সম্মেলনের প্রথম দিনের আলোচনার সঞ্চালনা করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. ফ্রানজিসকা ওহনসোর্গে। আলোচক হিসেবে ছিলেন:
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. শান্তায়ানান দেবরাজন।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশন্স (ICRIER)-এর পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ড. দীপক মিশ্র।
ভূ-অর্থনৈতিক বিভাজনের প্রভাব
‘দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ভূ-অর্থনৈতিক বিভাজনের প্রভাব’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধে ড. ফ্রানজিসকা ওহনসোর্গে বলেন, ভূরাজনৈতিক বিভাজন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়। তবে কিছু উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতি বৈচিত্র্যময় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতির মাধ্যমে এই ঝুঁকি কমাতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার রপ্তানি ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) উৎসগুলো ভূরাজনৈতিকভাবে বৈচিত্র্যময় হলেও, এই অঞ্চলের মোট বাণিজ্য ও এফডিআই প্রবাহ বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে না।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা
ড. শান্তায়ানান দেবরাজন বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উচিত নিজেদের মধ্যে এবং বৈশ্বিকভাবে বাণিজ্য বৃদ্ধি করা। তিনি উল্লেখ করেন, ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বর্তমানের তুলনায় ১০ গুণ বেশি হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলো যখন শুল্ক বাড়ায়, তখন ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য বাণিজ্য উন্মুক্ত করাই সর্বোত্তম কৌশল।
দক্ষিণ এশিয়ায় সংস্কার বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণ
ড. শান্তায়ানান দেবরাজন বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সংস্কার কম হওয়ার মূল কারণ অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। তিনি উল্লেখ করেন, বাণিজ্য উদারীকরণ না করার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া এখন একটি পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজনীতি ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক
ড. দীপক মিশ্র বলেন, অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সম্পর্ক রাজনৈতিক সম্পর্কের অংশ হয়ে ওঠে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় অত্যন্ত প্রকট।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে রাজনৈতিক মতানৈক্য থাকলেও তারা অর্থনৈতিক সম্পর্ক আলাদা রাখতে পেরেছে, যার ফলে তারা দ্রুত অগ্রগতি করেছে।
তিনি আরও বলেন, যদি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অর্থনৈতিক সংস্কার করতে পারে, তবে এই অঞ্চল হবে বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় বাণিজ্য অঞ্চল।