১৬ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার
৩১শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডি আত্মসাৎ করেছেন হাজার কোটি টাকা

শেয়ার করুন

দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) বেসরকারি পূবালী ব্যাংকের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট গঠন করে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছে। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে কমপক্ষে পাঁচ পরিচালকের একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটিতে লুটপাট ও অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, চক্রের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আগামী কয়েক দিনের মধ্যে নোটিশ পাঠানো হবে।

এদিকে, পূবালী ব্যাংকের বিরুদ্ধে পৃথক তদন্ত শুরু করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সংস্থাটির একজন যুগ্ম পরিচালকের নেতৃত্বে ঋণ বিতরণে অনিয়ম, ডলার কারসাজি, অর্থ পাচার, নিয়োগবাণিজ্য, বন্ধকী সম্পত্তি স্বল্পমূল্যে বিক্রিসহ বিভিন্ন অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। তবে, এই তদন্তকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাও চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে জনৈক ফরহাদ হোসেন দুদকে একটি অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগে পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুরুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ আলী, সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজ আহমেদ মজুমদার, পরিচালক ফাহিম আহমেদ ফারুক এবং অন্য পরিচালক খবিরুজ্জামান ইয়াকুবের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। দুদক অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে এবং ঢাকা-১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. হাফিজুর রহমানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

দুদকের অভিযোগ অনুযায়ী, পূবালী ব্যাংকে একটি শক্তিশালী চক্র ব্যাপক অনিয়ম, নিয়োগবাণিজ্য, ডলার কারসাজি, সম্পত্তি বিক্রি, ঋণ বিতরণে অনিয়মসহ নানা দুর্নীতিতে জড়িত। বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় এবং বাণিজ্যের আড়ালে রহস্যজনক অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত ইতিপূর্বে ক্ষমতার দাপটে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পূবালী ব্যাংকের এই চক্রের অন্যতম হোতা ছিলেন প্রয়াত এইচটি ইমামের ভাগনে মোহাম্মদ আলী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটির এমডি ও সিইও পদে রয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সাইদুর রহমান ও এস কে সুরের সহযোগিতায় এই চক্র ব্যাংকটিকে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করে। ২০২৩ সালে এই চক্র ডলার কারসাজির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে। বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ডলার কিনে ২১১ কোটি টাকা বেশি ব্যয় বা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, মঞ্জুরুর রহমান ও মোহাম্মদ আলী চক্র হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসীদের এক্সচেঞ্জ করা শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেলে না দিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন বলে দুদকের তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

দুদক সূত্র আরও জানায়, ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ২৫ লাখ গ্রাহকের আমানতের ১ হাজার ১৪১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পূবালী ব্যাংকের অন্যতম অংশীদার ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারধারী হিসেবে মঞ্জুরুর রহমান পরিচালক ছিলেন। তিনি ডেল্টা লাইফে তার চার সন্তানকে পরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছেন এবং কন্যা আদিবা রহমানকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদে বসিয়েছেন। ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে তিনি পূবালী ব্যাংকেও লুটপাট অব্যাহত রেখেছেন। ডেল্টা লাইফের ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা আত্মসাতের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ডাটাবেজ সার্ভারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুছে ফেলার অভিযোগও রয়েছে মঞ্জুরুর রহমানের বিরুদ্ধে।

এছাড়া, পূবালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদারের বিরুদ্ধেও অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালে অনিয়মের দায়ে ১০ পরিচালককে সরানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। হাফিজ আহমেদ মজুমদার বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া, ভাইস চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান, পরিচালক ফাহিম আহমেদ ফারুক চৌধুরী ও এম খাবিরুজ্জামান ইয়াকুবসহ কয়েকজন এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা বলে দুদকের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগে আরও বলা হয়, সাবেক এমপি হাফিজ আহমেদ মজুমদার বর্তমানে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান। তার আগে চেয়ারম্যান ছিলেন মঞ্জুরুর রহমান। তারা দুজনই প্রায় দেড় যুগ ধরে পূবালী ব্যাংক ও ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যানের পদ দখল করে লুটপাট ও অর্থ আত্মসাৎ করছেন।

পূবালী ব্যাংকের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম বলেন, “এই বিষয়ে আমার কাছে এখনো কোনো তথ্য আসেনি। তদন্ত চলমান। আর কিছু বলতে পারব না।”

দুদকের উপপরিচালক মো. আখতার হোসেন বলেন, “অভিযোগ জমা হওয়ার পর তা আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।”

এ বিষয়ে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

শেয়ার করুন