১৬ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার
৩১শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

লিবিয়া উপকূলে নিহতদের মধ্যে ১০ জনই মাদারীপুরের

শেয়ার করুন

অবৈধভাবে লিবিয়া হয়ে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিহত ২৩ জনের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় মিলেছে। তাদের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায়। নিহতদের মধ্যে দুজন মামা ও ভাগ্নে সম্পর্কিত। এ ঘটনায় পুরো উপজেলায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। স্বজন ও এলাকাবাসী এ ঘটনায় জড়িত দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে। পুলিশ বলছে, এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশাসন নিহতদের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের হাসান মাতুব্বর ও কুলসুম বেগমের ছেলে টিটু হাওলাদার পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। নৌকাডুবিতে তিনি মারা যান। মোবাইলে ছেলের মৃত্যুর ছবি দেখে কুলসুম বেগম শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তিনি বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন এবং ছেলেকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলছেন।

কুলসুম বেগম বলেন, ‘আমি আমার বাবাকে চাই। আমার এই একটাই সন্তান। অনেক কষ্ট করে তাকে বড় করেছি। আমি রফিক দালালকে ১৬ লাখ টাকা দিয়েছি। সে বলেছিল, আমার ছেলেকে সুন্দরভাবে পাঠাবে।’

টিটুর বাবা হাসান হাওলাদারও শোকে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক কষ্ট করে আমার ছেলেকে বড় করেছি। অনেক ধারদেনা করে তাকে পাঠিয়েছি। এখন আমি কীভাবে ধারদেনা শোধ করব? আমার ছেলে তো নেই। গতকাল দালাল আমার ছেলের লাশের ছবি পাঠিয়েছে। আমি এখন কী করব?’

টিটু হাওলাদারের মামা আবুল বাশার আকনের বাড়িতেও শোকের ছায়া নেমে এসেছে। নিহত টিটু হাওলাদারের মামা আবুল বাশার আকনের বড় ভাই বাচ্চু আকন বলেন, ‘আমি আমার ভাই ও ভাগিনাকে হারিয়েছি। আমার ভাইয়ের জন্য দুবারে দুই দালালকে ২৮ লাখ টাকা দিয়েছি। জমি-জমা বিক্রি করেছি, ধারদেনা করেছি। এখন আমরা সর্বশান্ত হয়ে গেছি। সরকারের কাছে দাবি করছি, টাকা-পয়সা সবই তো গেছে। এখন আমার ভাই ও ভাগিনার লাশ সরকার যেন ফিরিয়ে দেয়। আর ঘটনার সঙ্গে জড়িত দালালদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি।’

শুধু টিটু হাওলাদারের পরিবারই নয়, মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ১০ যুবকের নৌকাডুবিতে মৃত্যুর ঘটনায় এলাকাজুড়ে শোকের মাতম চলছে। নিহতদের স্বজনরা জানায়, দালালদের খপ্পরে পড়ে গত জানুয়ারি মাসের শুরুতে ইতালির উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার সুন্ধিকুড়ি গ্রামের সাগর বিশ্বাস, আশীষ কীর্তনীয়া, সাগর বাড়ৈ, শাখারপাড়ের সজীব মোল্লা, সাদবাড়িয়ার রাজীব হোসেন, বৌলগ্রামের অনুপ সরকার ও নৃপেন কীর্তনীয়া, গোবিন্দপুর গ্রামের ইনসান শেখ ও আবুল বাশার। পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের টিটু হাওলাদার ও গোবিন্দপুর গ্রামের আবুল বাশার মামা-ভাগ্নে ছিলেন। আবুল বাশার লিবিয়া কয়েক মাস আগেই গিয়েছিলেন। পরে তার ভাগ্নে টিটু হাওলাদারও যান। গত ২৪ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যাত্রা করেন তারা। মাঝপথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারায় ২৩ জন। এর মধ্যে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার এই ১০ তরুণও রয়েছেন।

পুলিশ দালালদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছে। নিহতদের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনতে দূতাবাসের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানিয়েছে পুলিশ প্রশাসন।

রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাসুদ হোসেন খান বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে শুনেছি লিবিয়ার ভূমধ্যসাগরে নিহত ২৩ বাংলাদেশির মধ্যে ১০ জনেরই বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায়। আমরা নিহতদের তালিকা তৈরি করে কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাব। যাতে লাশগুলো দেশে স্বজনদের কাছে ফেরত আসে, সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

ওসি মাসুদ হোসেন খান আরও বলেন, ‘এ ঘটনায় রাজৈর হরিদাসদি গ্রামের স্বপন মাতুব্বর, মজুমদারকান্দি গ্রামের মনির হাওলাদার ও ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার আলীপুরের রফিকুল ইসলাম দালাল জড়িত থাকার কথা মৌখিকভাবে শুনেছি। ঘটনার পর থেকে দেশে থাকা দালালরা আত্মগোপনে রয়েছেন। অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

শেয়ার করুন