১৭ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার
১লা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিশ্ব গাড়িমুক্ত দিবস ২০২৫: ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে নগরজীবন

শেয়ার করুন

জাকারিয়া মোহাম্মদ ইমন, ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : বিশ্বব্যাপী ২২শে সেপ্টেম্বর “বিশ্ব গাড়িমুক্ত দিবস” পালিত হয়ে আসছে মানুষের জীবনে পরিবেশবান্ধব চলাচলের গুরুত্ব তুলে ধরতে। নগর জীবনে ব্যক্তিগত গাড়ির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কেবল শহরের যানজটই বাড়াচ্ছে না, বরং এর ফলে পরিবেশ, সামাজিক জীবন, জনস্বাস্থ্য ও খোলা জায়গার উপর পড়ছে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব। ঢাকা শহরের মতো ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, অথচ এর সাথে তাল মিলিয়ে উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা কিংবা পর্যাপ্ত খোলা স্থান তৈরি হচ্ছে না। এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে উঠছে দুর্বিষহ।

বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজার হাজার নতুন গাড়ি সড়কে নামছে। গবেষণা বলছে, ঢাকার সড়কে চলাচলকারী মোট যানবাহনের প্রায় ৭০ শতাংশই ব্যক্তিগত গাড়ি, অথচ এরা বহন করে নগরবাসীর মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ যাত্রীকে। অর্থাৎ, নগরের বৃহৎ অংশের মানুষ গণপরিবহনের ওপর নির্ভরশীল হলেও সড়ক দখল করে রেখেছে স্বল্পসংখ্যক ধনী শ্রেণির ব্যক্তিগত গাড়ি। এর ফলে প্রতিদিনের যানজট, দীর্ঘ ভ্রমণ সময় ও অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ হয়ে উঠেছে নাগরিক দুর্ভোগের প্রধান কারণ।

ঢাকা শহরে আজ সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অবৈধ পার্কিং। অফিস, হাসপাতাল, শপিং মল, এমনকি স্কুল-কলেজের আশেপাশে সঠিক পার্কিং ব্যবস্থার অভাবে ব্যক্তিগত গাড়িগুলো যেখানে-সেখানে পার্ক করা হয়। ফুটপাত, রাস্তার ধারে কিংবা খেলার মাঠ পর্যন্ত গাড়ির দখলে চলে যাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের হাঁটার জায়গা সংকুচিত হচ্ছে, পথচারীরা প্রতিদিন ভোগান্তিতে পড়ছেন। অন্যদিকে, শহরে যেসব খোলা জায়গা ছিল, সেগুলোও ক্রমে গাড়ির চাপের কারণে দখল হয়ে যাচ্ছে। নগরের শিশুদের খেলার মাঠ কিংবা মানুষের হাঁটার জায়গা এখন কেবল গাড়ির জন্যই বরাদ্দ।

ব্যক্তিগত গাড়ির অতিরিক্ত ব্যবহার শুধু যানজট ও জায়গার সংকটই তৈরি করছে না, বরং পরিবেশের ওপর ফেলছে গভীর প্রভাব। গাড়ি থেকে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও অন্যান্য দূষিত গ্যাস নগরের বাতাসকে প্রতিনিয়ত দূষিত করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) রিপোর্ট অনুযায়ী, ঢাকার মতো বড় শহরে বায়ুদূষণের অন্যতম বড় উৎস হলো মোটরযান। এই দূষণ হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসজনিত রোগ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। একইসাথে কার্বন নিঃসরণ জলবায়ু পরিবর্তনের গতি ত্বরান্বিত করছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য সরাসরি দায়ী।গণপরিবহনগবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় প্রতিদিন গাড়ি থেকে প্রায় ৪,০০০–৫,০০০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। বাংলাদেশে মোট কার্বন নিঃসরণের মধ্যে পরিবহন খাতের অবদান প্রায় ১৫%। যদিও বৈশ্বিক তুলনায় এটি কম, কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ নগরে এ দূষণের প্রভাব বহুগুণ বেশি।

যানজট ও জ্বালানি অপচয়ের কারণে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার যানজটে বছরে প্রায় কয়েক বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। ব্যক্তিগত গাড়ির আধিক্য এই সমস্যাকে বহুগুণ বাড়াচ্ছে। একইসাথে, জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপও বাড়ছে।

ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার অনেকটা সামাজিক বিভাজন তৈরি করছে। নগরের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যেখানে সীমিত ও অস্বস্তিকর গণপরিবহন ব্যবস্থায় যাতায়াত করতে বাধ্য, সেখানে নগরের সড়কের বৃহৎ অংশ দখল করছে সীমিতসংখ্যক গাড়ি মালিকরা। এটি কেবল একটি পরিবহন সংকট নয়, বরং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নও তৈরি করছে।

ব্যক্তিগত গাড়ির বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে হলে নগর পরিকল্পনায় গণপরিবহন ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। মেট্রোরেল, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (BRT), সাইকেল লেন ও হাঁটার উপযোগী রাস্তা তৈরি করে শহরকে আরও মানবিক করতে হবে। উন্নত শহরগুলো ইতোমধ্যে গাড়িমুক্ত দিবসকে কাজে লাগিয়ে সচেতনতা তৈরি করছে—যেখানে নির্দিষ্ট দিনে শহরের প্রধান সড়কগুলো ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত রাখা হয় এবং মানুষকে সাইকেল, হাঁটা কিংবা গণপরিবহন ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়।

বিশ্ব গাড়িমুক্ত দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, নগর জীবনে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর অযথা নির্ভরশীলতা ভবিষ্যতের জন্য টেকসই সমাধান নয়। এটি মানুষের চলাচলের স্বাধীনতা সীমিত করছে, পরিবেশকে ধ্বংস করছে এবং সামাজিক বৈষম্য বাড়াচ্ছে। নগরকে বাসযোগ্য রাখতে হলে গণপরিবহন, সাইকেল ও হাঁটাচলার সুযোগ বাড়াতে হবে এবং ব্যক্তিগত গাড়ি নির্ভরতা কমাতে হবে। গাড়িমুক্ত দিবস কেবল প্রতীকী নয়, বরং আমাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অপরিহার্য দিকনির্দেশনা।

শেয়ার করুন