
কুমিল্লায় ত্রিভুজ প্রেমের জেরে একটি গ্রামে লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছে। দিনব্যাপী হামলা, বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। বুধবার (২৩ এপ্রিল) দিনব্যাপী জেলার বরুড়া উপজেলার ভাউকসার ইউনিয়নের ভাউকসার মুহুরি বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ওই বাড়ির আবদুল জলিলের বসত ঘরটিতে তাণ্ডব চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। পুরো বাড়িজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাণ্ডবের চিত্র।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ভাউকসার মুহুরি বাড়ির কৃষক দল নেতা আবদুল জলিলের ছেলে জিহাদুল ইসলামের (২০) সঙ্গে আড্ডা গ্রামের প্রবাসী সুমন মিয়ার মেয়ে জান্নাতুল মাওয়ার (১৮) ফেসবুকে পরিচয় হয়। একপর্যায়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন দুজন। মাস ছয়েক আগে বিয়ে করে ভাউকসার নিজ বাড়িতে জান্নাতকে বউ করে আনে জিহাদ। বিয়ের কয়েকদিন পর জিহাদ ঢাকায় চলে যান কর্মের সন্ধানে। এরমধ্যে জিহাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় বরুড়া পৌরসভার তলাগ্রাম গ্রামের শিহাবের সঙ্গে মেসেঞ্জারে চ্যাটিং শুরু হয় জান্নাতের।
মাস তিনেক আগে এক দিন জান্নাতকে মেসেঞ্জারে প্রেমের প্রস্তাব দেন শিহাব। সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জান্নাত। কয়েকদিন পর জান্নাতকে তার বাবার বাড়ি আড্ডায় পাঠাবেন তার স্বামী জিহাদ। সেজন্য শিহাবের সহযোগিতা চান জিহাদ। জিহাদ ঢাকায় থাকার সুবাদে শিহাবকে অনুরোধ করে জান্নাতকে যেন গাড়িতে তুলে দেয়। শিহাব তাতে রাজি হয়। গাড়িতে তুলে দেওয়ার নাম করে জান্নাতের কাছ থেকে তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেন শিহাব। এ সময় শিহাব জান্নাতকে হুমকি দেন, তাকে বিয়ে করতে রাজি হলে তার মোবাইল ফিরিয়ে দেবেন। পরে ঘটনার বিস্তারিত স্বামী জিহাদকে জানান জান্নাত।
কয়েকদিন আগে ঢাকা থেকে বাড়ি আসেন জিহাদ। স্ত্রী জান্নাতের সঙ্গে মোবাইল উদ্ধারের পরিকল্পনা করে স্বামী জিহাদ। এরপর বুধবার শিহাবকে একটি নির্জন স্থানে আসতে বলে জান্নাত। এ সময় জান্নাত শিহাবকে প্রলোভন দেখায় শিহাবকে বিয়ে করে পালিয়ে যাবে। শিহাব নির্ধারিত স্থানে এলে আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা স্বামী জিহাদ ও তার বন্ধু রাকিব শিহাবকে আটক করে। এ সময় শিহাবকে মারতে গেলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন জিহাদের ফুফাতো ভাই সাগর। সাগর শিহাবকে মারতে বাধা প্রদান করেন। বিষয়টি পারিবারিকভাবে মিটমাট করার প্রস্তাব দেন সাগর। কিন্তু রাকিব সাগরের বাধা উপেক্ষা করে শিহাবকে মারতে থাকেন।
এ সময় সাগর ক্ষিপ্ত হয়ে রাকিবকে গালে থাপ্পড় দিলে রাকিব ক্ষিপ্ত হয়ে তার বন্ধুদের ফোন করেন। মিনিট বিশেকের মধ্যে পাশের গালিমপুর থেকে অন্তত ১০০-১৫০ জন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ছুটে আসেন ভাউকসার গ্রামে। এ সময় সাগর কূল-কিনারা না পেয়ে জিহাদদের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন। এতে রাকিবের বন্ধুরা জিহাদদের ঘরে দফায় দফায় হামলা চালান। দালান ঘরের বারান্দার গ্রিল ভেঙে ঘরে প্রবেশের চেষ্টা করা হয়। বুধবার দিনব্যাপী নারকীয় এ তাণ্ডব চালানো হয় জিহাদদের ঘরে।
অপরদিকে ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এদিন দুপুরে পুলিশকে ফোন করা হলেও পুলিশ আসে রাতে। পরে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে দুর্বৃত্তরা। পরে পুলিশ শিহাবকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। জিহাদদের ঘরে আটকে থাকা সাগর পালিয়ে গিয়ে কোনোরকমে জীবন বাঁচান। পরে বুধবার গভীর রাতে খড়ের মাচায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জান্নাতের স্বামী জিহাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জান্নাত আমার বিয়ে করা স্ত্রী। জান্নাতের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক এবং বিয়ে করা নিয়ে শিহাব আমাকে সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সে আমার বিয়ে করা স্ত্রীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। শিহাব আমার স্ত্রীর মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে। পরে ওই মোবাইল উদ্ধার করতে আমরা একটি পরিকল্পনা করি। কিন্তু মাঝখানে আমার ফুফাতো ভাই সাগর এসে সব গন্ডগোল বাঁধাল। রাকিব ফোন করে শত শত লোক এনে আমাদের বাড়িঘর ভাঙচুর করেছে। আমরা এর বিচার চাই।
জিহাদের বাবা আবদুল জলিল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলে প্রেম করে বিয়ে করার পর আমরা বউ হিসেবে জান্নাতকে মেনে নিয়েছি। কিন্তু গতকাল গালিমপুর থেকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা আমার বাড়িতে নারকীয় হামলা চালিয়েছে। রাতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। পুলিশকে দুপুরে ফোন করা হলেও পুলিশ এসেছে রাতে। পুলিশ চলে যাওয়ার পর আবার রাতে সন্ত্রাসীরা এসে বাড়িঘর ভাঙচুর করে আগুন দিয়েছে। আমি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এ বিষয়ে জান্নাতুল মাওয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি জিহাদকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। শিহাব আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তিনি আমাকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার কথা বলে আমার মোবাইল ছিনিয়ে নেন। বিয়ে না করলে আমার মোবাইল ফিরিয়ে দেবে না বলে। পরে আমি আর আমার স্বামী মিলে পরিকল্পনা করে শিহাবকে ডেকে আনি। তারপর এত বড় ঘটনা ঘটে গেল।
ঘটনার পর শিহাব আত্মগোপনে চলে যান। তার মোবাইল নম্বর বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
শামছুল আলম নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমাদের গ্রামে এমন ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা আর ঘটেনি। বুধবার সারাদিন আমাদের গ্রামে যে ঘটনা ঘটেছে সেটি সারাজীবন মনে থাকবে।
ভাউকসার ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাশরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে দুর্বৃত্তদের নিবৃত করার চেষ্টা করি। কিন্তু তারা আমাকেও অসম্মান দেখিয়েছে।
বরুড়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী নাজমুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, হামলার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ফোর্স পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় এখনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। শুনেছি ভুক্তভোগী পরিবার মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা মামলা করতে এলে সব সহযোগিতা করা হবে।