
দেশে অনুমিত ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। প্রতি বছর আড়াই থেকে ৩ লাখ নতুন রোগী এই পরিসংখ্যানে যুক্ত হয়। এদের মধ্যে একটি বড় অংশ চিকিৎসার বাইরে থেকে যায়, আরেকটি অংশ অপচিকিৎসার শিকার হয়। মাত্র এক-চতুর্থাংশ রোগী সঠিক চিকিৎসা পান, যাদের অর্ধেকই দ্বিতীয় বা তৃতীয় পর্যায়ে চিকিৎসা নিতে আসেন, যখন সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। এছাড়া, অনেকের পক্ষে ক্যান্সার চিকিৎসার উচ্চ ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হয় না। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ ৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য হলো ‘ইউনাইটেড বাই ইউনিক’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমেই বিপুল সংখ্যক মানুষকে ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব। ক্যান্সার প্রতিরোধের দিকে বেশি নজর দেওয়া জরুরি, কারণ ক্যান্সার শুধু ব্যক্তিগত কষ্টই বাড়ায় না, সামষ্টিক অর্থনীতির ওপরও চাপ সৃষ্টি করে। শারীরিক যন্ত্রণা এবং যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু তো রয়েছেই।
এ প্রসঙ্গে ক্যান্সার রোগতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, বিশ্বায়নের প্রভাবে বাংলাদেশেও ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড এবং ক্যান ফুডের ব্যবহার বেড়েছে। এসব খাবারে প্রচুর পরিমাণে চিনি, লবণ এবং ট্রান্সফ্যাট (রূপান্তরিত চর্বি) থাকে, যা ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। এগুলো শুধু হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকিই বাড়ায় না, ক্যান্সারেরও কারণ হতে পারে। এছাড়া, রেড মিট বা পশুর মাংসও ক্ষতিকর। তিনি পরামর্শ দেন, এসব খাবার এড়িয়ে শাকসবজি, ফলমূল এবং আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত। স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমেই ক্যান্সার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
জাঙ্ক ফুড ক্যান্সারের একটি বড় ঝুঁকির কারণ। শুধু চিনিই নয়, সোডা পানীয়ও ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। গ্রিল করা বা ঝলসানো মাংস খেতে যারা পছন্দ করেন, তারাও ঝুঁকিতে রয়েছেন। উচ্চ তাপমাত্রায় মাংস প্রস্তুত করলে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী হাইড্রোকার্বন তৈরি হয়। এছাড়া, বেশিরভাগ মাইক্রোওয়েভ পপকর্নের প্যাকেটে ব্যবহৃত ‘পারফ্লুরোঅক্টানোইক অ্যাসিড’ নামক রাসায়নিক উপাদান স্তন, বৃক্ক, মূত্রথলি, কোলোরেক্টাল, প্রোস্টেট, ফুসফুস, থাইরয়েড, লিউকেমিয়া এবং লিম্ফোমা ক্যান্সারের জন্য দায়ী। ক্যানে থাকা খাবার দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হাইড্রোজেনেইটেড অয়েল বা ট্রান্স-ফ্যাটও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও পরজীবীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে বিভিন্ন জীবাণুরোধী ওষুধ, কীটনাশক এবং কারসিনোজেনিক রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, কৃত্রিম সুইটেনার শরীরে টক্সিন তৈরি করে এবং মস্তিষ্কের টিউমার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
আটা পরিশোধনের সময় এর প্রায় সব পুষ্টিগুণই নষ্ট হয়ে যায়। পরে একে ক্লোরিন গ্যাসের সাহায্যে ব্লিচ করা হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। নন-অর্গানিক ফল বা সবজি চাষের সময় ব্যবহৃত কীটনাশকও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রক্রিয়াজাত মাংস (যেমন সসেজ, হট ডগ) খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। হাইড্রোজেনেইটেড ভেজিটেবল অয়েলে ভাজা চিপস এবং অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবারও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। উচ্চ তাপমাত্রায় ভাজা আলুর চিপসে অ্যাক্রিলামাইড নামক কারসিনোজেনিক উপাদান তৈরি হয়, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
জিএমও (জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম) সম্পর্কে গবেষণায় দেখা গেছে, কৃত্রিমভাবে জেনেটিক মডিফিকেশন করা খাবার মানুষের পাকস্থলী ও অন্ত্রে হজম হয় না এবং রক্তের মাধ্যমে সাধারণ ডিএনএর সঙ্গে মিশে যায়। এর ফলে স্তন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড লেভেল বাড়িয়ে প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রক্রিয়াজাত ও কৃত্রিম চিনি শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়ানোর পাশাপাশি ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধিতে সহায়ক। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত জার্মান চিকিৎসক ওটো ওয়ারবার্গ ১৯৩১ সালে প্রমাণ করেছিলেন যে, টিউমার ও ক্যান্সার কোষ বেড়ে উঠতে উচ্চ মাত্রায় ফ্রুক্টোজ যুক্ত চিনির ওপর নির্ভরশীল।