১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার
১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘মিনিস্ট্রি অডিটে’ ঘুষ—এক মাসের বেতনই রেট

শেয়ার করুন
Hands passing money under the table corruption and bribery

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, আর্থিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি ধরার দায়িত্বে থাকা পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) নিজেই এখন দুর্নীতির গভীর লঙ্কায় পরিণত হয়েছে। ‘মিনিস্ট্রি অডিট’ নামের পরিদর্শনে ডিআইএর কর্মকর্তারা নিয়মিত ঘুষ নিচ্ছেন—গড়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীর এক মাসের বেতনই ঘুষের রেট। সাম্প্রতিক নথি, অডিও রেকর্ড ও অভিযোগ যাচাই করে জানা গেছে, অন্তত ১৬ জন কর্মকর্তা মিলে একটি শক্তিশালী ঘুষ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। অনেক ক্ষেত্রে দুই মাসের বেতনের সমপরিমাণ ঘুষও দাবি করা হয়েছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ডিআইএতে নেতৃত্বে পরিবর্তন এলেও ঘুষের রেট কমেনি; বরং কিছু ক্ষেত্রে বেড়েই গেছে। দুর্নীতি ঠেকাতে সর্বশেষ পরিচালক সাইফুল ইসলাম গোয়েন্দা সংস্থা, মসজিদের ইমাম ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নজরদারিতে যুক্ত করলেও কার্যত কোনো পরিবর্তন হয়নি। নতুন পরিচালক শহিদুল ইসলামও একই পদ্ধতি অনুসরণ করছেন, কিন্তু ঘুষবাণিজ্য চলছেই।

কালবেলার অনুসন্ধানে সর্বশেষ ২০টি পরিদর্শন টিমের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে—প্রায় প্রত্যেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। পটুয়াখালীর বাউফলের নওমালা ফাজিল মাদ্রাসার ঘটনায় শিক্ষকদের এক মাসের বেতন—সাড়ে ৭ লাখ টাকা—ঘুষ নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অডিটর সিরাজুল ইসলামের কাছে প্রথম দফায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা পৌঁছানোর অডিওও পাওয়া গেছে।

চট্টগ্রামের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকেও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ এসেছে। ডিআইএর তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১১৫২টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন হয়; এর মধ্যে ৭০০ প্রতিষ্ঠান থেকে ঘুষ নেওয়া হয়েছে। গড়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে ৭ লাখ টাকা করে লেনদেন ধরা হলে, ঘুষের অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ৫০ কোটি টাকা।

বিভিন্ন অডিও রেকর্ডে অধ্যক্ষদের বলতে শোনা যায়—‘মিনিস্ট্রি অডিট’ দল এলে এক মাসের বেতন দিতে হয়, না হলে খারাপ প্রতিবেদন দিয়ে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত ঝামেলায় ফেলবে। অনেক শিক্ষক-কর্মচারী ঘুষ দিলেও পরে অস্বীকার করতে বাধ্য হন—কারণ স্বীকার করলে আরও ‘খারাপ রিপোর্ট’ দেওয়ার ভয় দেখানো হয়।

গোপালগঞ্জ, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলায় একাধিক ডিআইএ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গোপালগঞ্জে সহকারী পরিদর্শক সুলতান আহমদ ১১ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করলেও অডিও রেকর্ডে টাকা আদায়ের প্রমাণ মিলেছে। একইভাবে পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদকে চট্টগ্রামে ১০টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২০০ স্টাফের কাছ থেকে অর্ধকোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

ডিআইএর পরিচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, সবাই অস্বীকার করায় ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। তবে অভিযোগ তদন্তে চেষ্টা চলছে।

ডিআইএতে মোট ৩০ কর্মকর্তা থাকলেও অভিযোগ অনুযায়ী ১৬ জন কর্মকর্তাই এই দুর্নীতির মূল সিন্ডিকেট। পরিদর্শক থেকে শুরু করে অডিট অফিসার ও অডিটর—একটি শক্তিশালী চক্র ঘুষের হার নির্ধারণ, রেস্ট হাউসে দরদাম ঠিক করা এবং ঢাকায় তৃতীয় ব্যক্তির মাধ্যমে টাকা নেওয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করছেন।

২০১৭ সালে দুদকের হাতে এক পরিদর্শক ঘুষসহ ধরা পড়ার পর থেকেই কর্মকর্তারা ঘুষ নেওয়ার ধরন বদলেছেন। এখন আর প্রকাশ্যে লেনদেন নয়—বরং দুর্বলতা দেখিয়ে ভয় ধরানো, ‘রেস্ট হাউসে দরদাম’, আর ঢাকার বাইরে গোপন স্থানে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে টাকা নেওয়াই নিয়মে পরিণত হয়েছে।

ঘুষের এই অনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য ডিআইএকে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান থেকে দুর্নীতির ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। যদিও সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, কিন্তু নথি, অডিও ও অভিযোগ বলছে ভিন্ন কথা।

সিএনআই/২৫

শেয়ার করুন