
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য থাকলেও, ভোটের সময় নিয়ে মতভেদ ছিল স্পষ্ট। কেউ জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে ভোট আয়োজনের পক্ষে, আবার কেউ নির্বাচনের আগেই গণভোট চেয়েছিল। অবশেষে আর্থিক খরচ, প্রশাসনিক প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকার সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। আগামী শুক্রবার জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পর এ বিষয়ে সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে।
সরকারি সূত্র জানায়, একই দিনে দুটি ভোট আয়োজন করলে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও কমবে। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) অনানুষ্ঠানিকভাবে এ প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছে। ইসির কর্মকর্তারা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনের জন্য যেভাবে প্রস্তুতি চলছে, গণভোট যুক্ত হলে তাতে অতিরিক্ত বড় কোনো জটিলতা তৈরি হবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একই দিনে দুটি ভোট আয়োজন প্রশাসনিকভাবে বড় চ্যালেঞ্জ হলেও সঠিক পরিকল্পনা থাকলে তা সম্ভব। তবে ভোটারদের বিভ্রান্তি এড়াতে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালাতে হবে এবং নির্বাচন কমিশনকে তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
জুলাই সনদের প্রস্তাব অনুযায়ী, সংবিধান ও রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে জনগণের মতামত নেওয়ার জন্য গণভোট অপরিহার্য। মূল প্রশ্ন থাকবে—জনগণ কি জুলাই সনদকে সমর্থন করে (‘হ্যাঁ’ বা ‘না’)? এই প্রশ্ন নিয়েই হবে আসন্ন গণভোট। তবে বিএনপিসহ বেশ কিছু দল জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের পক্ষে, আর জামায়াত ও এনসিপি নির্বাচনের আগেই ভোট করার দাবি জানিয়ে আসছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকগুলোতেও দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হয়নি। ফলে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে ভোটের সময় নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে কমিশন। শনিবার জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে বৈঠকের পর কমিশনের অভ্যন্তরীণ বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয়—একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনই হবে বাস্তবসম্মত পথ।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। এ নির্বাচনে প্রায় ১২ কোটি ৬০ লাখ ভোটার অংশ নেবেন, ৪০ হাজারের বেশি ভোটকেন্দ্রে আড়াই লক্ষাধিক ভোটকক্ষ থাকবে। মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। একই দিনে গণভোট হলে এই বাজেট সামান্য বৃদ্ধি করলেই যথেষ্ট হবে। আলাদা দিনে ভোট আয়োজন করলে খরচ দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ বলেছেন, “গণভোটের সিদ্ধান্ত সরকারের বিষয়। সরকার চাইলে আমরা একই দিনে এটি আয়োজন করতে পারব। এতে সময় ও অর্থ দুইই সাশ্রয় হবে।”
অন্যদিকে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, “দলগুলো ঐকমত্যে না পৌঁছালেও সরকারের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সরকার বাস্তবতা বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবে।”
বাংলাদেশে সর্বশেষ গণভোট অনুষ্ঠিত হয় সামরিক শাসনামলে। সংবিধানে গণভোটের বিধান প্রথম যুক্ত হয় ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের সময়, পরে ২০১১ সালে তা বাতিল হয়। তবে সাম্প্রতিক সাংবিধানিক পরিবর্তনের পর আবার সেই বিধান ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তাই আসন্ন গণভোট হবে দীর্ঘ সময় পর বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ঘটনা।