১৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার
৩০শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নারীর পোশাক নাকি বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি: ধর্ষণের পেছনে কারণ কী

শেয়ার করুন

বর্তমান সমাজের এক কলুষিত অধ্যায় ধর্ষণ। বাংলাদেশে ধর্ষণের সংখ্যা যেন বেড়েই চলেছে। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশু, কিশোরী, নারী এবং বৃদ্ধ নারীরা। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এর পেছনে দায়ভার কার? নারীর পোশাক, নাকি বিকৃত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির?

সমাজে একশ্রেণির মানুষ রয়েছে, যারা নারীর ধর্ষণের পেছনে নারীর পোশাককে দোষারোপ করে। যদি নারীর পোশাকই ধর্ষণের পেছনের কারণ হতো, তাহলে শিশু ধর্ষিত হতো না, বৃদ্ধ নারীও ধর্ষিত হতো না। অনেকে মনে করে, বোরকা পরিধান করলে, নিজেকে কাপড় দ্বারা আবৃত করলে ধর্ষণ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। তবে এর কোনোটাই হয় না। ধর্ষণের জন্য কেবল ধর্ষক দায়ী। নারীর পোশাক নয়। সমাজের এই বিকৃত মনমানসিকতার কারণে নারীদের হেনস্তা হতে হচ্ছে। অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী আমরা জানতে পারি, শুধু গত কয়েক বছরে হাজারো নারী ও শিশুকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই ছিল স্কুলের পোশাক পরিহিত শিশু, কেউবা পরিবারের মধ্যে নিরাপদ মনে করা পোশাকেই। গ্রামাঞ্চলে যেখানে নারীরা বোরকা বা শাড়ি পরেন, সেখানেও এমন অপরাধ ঘটছে নিয়মিত। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গবেষণাও দেখিয়েছে, পোশাক ধর্ষণের কারণ নয়; বরং মূল কারণ হলো অপরাধীর মানসিক বিকৃতি, সামাজিক অবক্ষয়, আর আইনের দুর্বল প্রয়োগ।

সমাজের বিকৃত মনমানসিকতা এবং বেড়ে চলা ধর্ষণ নারীদের নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সমাজের বিকৃত মনমানসিকতা এবং এই ধর্ষণের পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সমাজের মানুষের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজের মানুষেরা মনে করে, নারী কোনো মানুষ নয়; তারা হচ্ছে ভোগ্যপণ্য। তাই এমন ঘটনাগুলো ঘটে প্রতিনিয়ত। অশিক্ষা ও সচেতনতার অভাব ধর্ষণের পেছনে দায়ী।

সমাজের সবাইকে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ শেখানো হয় না; বরং তাকে দুর্বল ভাবা হয়। যার কারণে নারী পরিণত হয় ভোগ্যপণ্যে। দুর্বল বিচারব্যবস্থার ফলে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ধর্ষকেরা কিছু টাকা জরিমানা দিয়েই ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। ফলে অধিকাংশ সময় ধর্ষিতারা বিচার চাইতেও আসছে না। মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও শাস্তির নিশ্চয়তা না থাকায় অপরাধীরা ভয় পায় না। ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষ নারীর ওপর জোর খাটাচ্ছে। রাজনীতি বা প্রভাবশালী পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায় অনেক ধর্ষক তৈরি হচ্ছে। তারা থেকে যাচ্ছে আইনের বাইরে।

পারিবারিক বৈষম্যও ধর্ষণে ভূমিকা রাখে। ছেলেদের স্বাধীনতা দেওয়া হয়, মেয়েদের সীমাবদ্ধ করা হয়। এতে ছেলেদের মধ্যে আধিপত্যবোধ জন্ম নেয়। মিডিয়ার অসুস্থ প্রভাব নয়, অসুস্থ দর্শক ধর্ষণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করছে। কোনো কনটেন্টকে অনেকে বিনোদন হিসেবে দেখে, আবার কেউ বিকৃত চিন্তার খোরাক বানায়।

সমাজে নারীদের দোষারোপ করা যতটা সহজ, দোষীকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া ততটাই কঠিন। হয়তো দোষীকে শাস্তি দিতে না পারার ব্যর্থতা থেকে তারা নারীকে দোষারোপ শুরু করে। কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সমাজে ধর্ষণের প্রবণতা কমানো যেতে পারে এবং সমাজের বিকৃত মনমানসিকতার পরিবর্তন আনা যেতে পারে মানসিকতার পরিবর্তন করার মাধ্যমে। শিক্ষা, পরিবার ও ধর্মীয় মূল্যবোধের মাধ্যমে নারীকে সম্মান করতে শেখাতে হবে।

শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই ছেলে-মেয়েকে সমান মর্যাদায় গড়ে তোলা প্রয়োজন। ছেলেদের অধিক স্বাধীনতা তাদের মনে নারীর ওপর আধিপত্য স্থাপনের মনমানসিকতার জন্ম দেয়। দ্রুত বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষকদের জন্য সময়োপযোগী ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যাতে ধর্ষণের চিন্তা মাথায় এলেও রুহ কাঁপে।

সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। মিডিয়া, সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। যাতে আমাদের সমাজে নতুন করে ধর্ষকের সৃষ্টি না হয়। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। নারীদের আর্থিক, সামাজিক ও আত্মরক্ষামূলক ক্ষমতা বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, নারী দুর্বল নয়। সমাজে সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। নারীকে শুধুই মা-বোন হিসেবে নয়, একজন পূর্ণ মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে হবে।

রাষ্ট্রে বসবাসরত প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। হোক সে নারী কিংবা পুরুষ। রাষ্ট্রের কোনো নিরীহ নাগরিকের সঙ্গে অন্যায়-অত্যাচার মানে সরকার এবং রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। প্রতিনিয়ত ঘটে চলা ধর্ষণ রোধে সরকারের উচিত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কেননা, নারীরা আমাদের রাষ্ট্রের মানবসম্পদ। তাদের ক্ষতি হওয়া মানে রাষ্ট্রের ক্ষতি হওয়া।

ধর্ষণের দায় নারীর পোশাকে চাপানো কেবল ভুক্তভোগীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ নয়, বরং অপরাধীকেও উৎসাহিত করে। আমাদের আসল দায়িত্ব হওয়া উচিত ধর্ষকদের এবং সমাজের মানুষদের মানসিকতা বদলানো এবং আইনকে আরও শক্তিশালী করা। কারণ, নারীর পোশাক নয়, বিকৃত মানসিকতাই ধর্ষণের জন্ম দেয়।

শেয়ার করুন