
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে উত্তাল উত্তরের জনপদ
‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’—এই স্লোগানে তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে পদযাত্রা শুরু করেছে তিস্তা রক্ষা আন্দোলন কমিটি। এই কর্মসূচিতে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি তিস্তাপাড়ের সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিয়েছেন।
গণপদযাত্রার সূচনা
মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টার পর উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় ১১টি পয়েন্ট থেকে একযোগে এ কর্মসূচি শুরু হয়। লালমনিরহাটের তিস্তা ব্রিজ থেকে শুরু হওয়া পদযাত্রাটি রংপুরের কাউনিয়া বাজারে গিয়ে শেষ হবে।
এর আগে, সোমবার সকাল থেকে তিস্তাপাড়ে ৪৮ ঘণ্টার লাগাতার অবস্থান, জনতার সমাবেশ ও পদযাত্রা কর্মসূচি শুরু হয়। রংপুর ও লালমনিরহাট জেলার তিস্তা রেলওয়ে সেতু-সংলগ্ন পয়েন্টে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
উত্তাল তিস্তার দুই পাড়
তিস্তা অববাহিকার রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামের ১১টি পয়েন্টে স্মরণকালের বৃহত্তম এই কর্মসূচিতে লাখো মানুষ অংশ নিয়েছেন। দ্বিতীয় দিনেও সমাবেশস্থলে সকাল থেকেই মানুষের ঢল নেমেছে। ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড হাতে হাজারো মানুষ ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে মুখরিত করেছেন তিস্তার দুই পাড়।
কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশীয় সংগীত, নৃত্য, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। বিকেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি গণসমাবেশে বক্তব্য দেবেন।
তিস্তা সংকট ও মহাপরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা
৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশে অবস্থিত। আন্তর্জাতিক নদী হওয়া সত্ত্বেও ভারত একতরফা বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ছয় লাখ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য পানি প্রত্যাহার করে নেয়, এরপর অবশিষ্ট পানি বাংলাদেশে ছেড়ে দেয়। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অনিয়ন্ত্রিত বন্যা ও নদীভাঙন দেখা দিচ্ছে।
নদী গবেষক ও উন্নয়ন বিশ্লেষকদের মতে, উত্তরের পাঁচ জেলার দুই কোটি মানুষের জীবনমান রক্ষায় একমাত্র সমাধান তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন। নদীকেন্দ্রিক কৃষিজমি রক্ষা, নদীভাঙন প্রতিরোধ এবং চরের সুরক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া না হলে প্রতি বছর উজানের পলিতে নদীর বুক ভরাট হয়ে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
তারা মনে করেন, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার পাশাপাশি নদী সংরক্ষণের বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি। যদি দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে তিস্তা নদীবেষ্টিত দুই হাজার বর্গকিলোমিটারের জনপদ।
বিএনপির কড়া বক্তব্য
কর্মসূচির উদ্বোধনী বক্তব্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে ভারতের কাছে অনেক কিছু দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তিস্তার এক ফোঁটা পানিও আনতে পারেনি। ৫৪টি অভিন্ন নদীর উজানে ভারত বাঁধ দিয়ে আমাদের কৃষকদের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করছে।”
ভারতের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, “বন্ধুত্ব করতে চাইলে আগে তিস্তার পানি দেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করেন। মাস্তানসুলভ আচরণ বন্ধ করে বাংলাদেশের অধিকার স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা ভারতকে বন্ধু হিসেবে দেখতে চাই, তবে সেটা হতে হবে সম্মানের ভিত্তিতে, ন্যায্য হিস্যা বুঝিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে।”
আন্দোলনের লক্ষ্য
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, “লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার পানির বৈষম্যের শিকার। এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচির মাধ্যমে গোটা বিশ্বকে জানিয়ে দেব যে, আমরা আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যা চাই।”
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে এই আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন।