
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) সিনিয়র-জুনিয়র পরিচয়ের আড়ালে র্যাগিংয়ের ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলা বিভাগের ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষের ১৬তম ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। রবিবার (২৩ নভেম্বর) রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ‘বিজয় ২৪’-এর ছাদে এ ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনার অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন; রাফি আহমেদ; মো. তামি; মেঘনাদ; আজিজুল; ফাহিম; মনিরুল ও সাকিল ফরহাদ।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী মিজান, তানজিম ও আশরাফ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সিনিয়র ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়মিত তাদের প্রতি অশালীন ভাষা ব্যবহার করতেন এবং বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করতেন। প্রথমদিকে বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও পরিস্থিতি যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন তারা বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি অবহিত করেন। অভিযোগ জানানোর পর কয়েকদিন ডাকাডাকি ও চাপ সৃষ্টির ঘটনা বন্ধ হলেও কিছুদিন পর একইভাবে আবারো ডেকে নেওয়া, হুমকি দেওয়া ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা শুরু হয় বলে দাবি করেন তারা।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আরও জানান, রবিবার সন্ধ্যায় পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। অভিযোগ অনুযায়ী, সেদিন ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভকে (সিআর) ফোন করে জরুরি কথা বলার নাম করে ব্যাডমিন্টন কোর্টে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে পৌঁছানোর পর তাকে এবং আরও কয়েকজনকে কোনো কারণ ছাড়াই তিরস্কার করা হয়। পরে একপর্যায়ে সবাইকে সাথে নিয়ে বিজয় ২৪ হলের ছাদে যেতে বলা হয়। ছাদে নেওয়ার পর শুরু হয় ভয়ভীতি প্রদর্শন ও অশালীন ভাষায় গালিগালাজ।
এসময় সবচেয়ে বেশি মারধরের শিকার হন ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী দ্বীন ইসলাম। অভিযোগ রয়েছে, ছাদে দাঁড় করিয়ে রেখে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন তাকে কানে জোরে থাপ্পড় মারেন। হঠাৎ আঘাতে দ্বীনের কান মুহূর্তেই শ্রবণক্ষমতা সাময়িকভাবে হারিয়ে ফেলেন। সহপাঠীরা জানান, আঘাত পাওয়ার পর দ্বীন ভারসাম্য হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং কিছুই ঠিকভাবে শুনতে পারছিলেন না।
পরিস্থিতি দেখে সেখানে উপস্থিত কিছু শিক্ষার্থী তাকে নিচে নামিয়ে এনে শান্ত করার চেষ্টা করেন। পরে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
দ্বীন ইসলাম ঘটনার বর্ণনায় জানান, “আমাকে কানে জোরে থাপ্পড় মারা হয়। সঙ্গে সঙ্গেই মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। এরপর কিছুই ঠিকমতো শুনতে পাইনি। সহপাঠীরা আমাকে ধরে নিয়ে নিচে আসে। পরে তারা আমাকে মেডিকেলে নিয়ে যায়।”
ঘটনাটি নিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুনের প্রতিক্রিয়া জানতে তাকে ফোন করা হলে তিনি সাড়া দেননি। একাধিকবার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি। তবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, ঘটনার পর মামুনকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করার চেষ্টা করেন। তাদের ভাষায়, মামুন দাবি করেন, “ওভাবে কিছু করা হয়নি, শুধু একটু হাত দিয়েছি।”
ঘটনার পর বিজয় ২৪ হলের প্রভোস্ট মো. আমির শরীফ জানান, র্যাগিং সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “ঘটনার তদন্ত চলছে তাই এখনও বিস্তারিত কিছু বলা সম্ভব নয়। তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পরই সঠিক তথ্য জনসাধারণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জানানো হবে।”
তিনি আরও জানান, এই তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী প্রভোস্ট ড. এ.টি.এম জিন্নাতুল বাসার। এছাড়া কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন সাইফুদ্দীন খালেদ এবং সহকারী প্রক্টর মো. ফায়সাল-ই-আলম।
এ বিষয়ে বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. শফিকুর রহমানের নিকট জানতে চাইলে তিনি জানান, “ঘটনা হলে ঘটেছে তাই হল প্রসাশন ব্যবস্থা নিবেন। প্রশাসনিক ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সতর্ক এবং র্যাগিং ও সহিংস আচরণের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা র্যাগিংয়ের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
সিএনআই/২৫