শতাব্দীর দীর্ঘতম খরায় এবার মৌসুমের শুরুতে শাক-সবজির উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। পরে নিয়মিত বৃষ্টির ফলে আশানুরূপ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। এখন সবজির ভরা মৌসুম।
বাজারে শীতের সবজির বিপুল সমারোহ, পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। সরবরাহ বাড়ছে প্রতিদিন, কমছে সবজির দাম। এখন সব ধরনের সবজির দামই ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে এসেছে। বর্তমানে একটি ফুলকপির দাম ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। শিম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি। করলার কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এক কেজি মুলা বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। একটি লাউয়ের দাম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
এক মাস আগে বর্তমান বাজারের তুলনায় সবজির দাম ছিল দ্বিগুণেরও বেশি। এর কারণ ছিল সরবরাহ সংকট। প্রথমে বন্যা এবং পরে খরার কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সবজির। তাতে দ্রুত বেড়ে যায় মূল্য। করোনায় কর্মহীনতা এবং সাম্প্রতিক মন্দায় মানুষের আয় কমে যাওয়ায় সবজি কিনতে হিমশিম খেয়েছে অনেকে। তবে এখন দাম স্বাভাবিক। আর কিছুদিন পর সবজির আরও দরপতন ঘটবে। মুলার দাম নেমে হবে প্রতিকেজি ১০ টাকায়। তখন অবশ্য কৃষকদের অভিযোগ শোনা যাবে- উৎপাদন খরচও উঠছে না। এই মূল্যবৃদ্ধি ও দরপতনের চালচিত্র হরহামেশাই আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত আমাদের জানা থাকা দরকার। দেখতে হবে বিভিন্ন সবজির উৎপাদন খরচ কত, কত এর গড় বিক্রয়মূল্য। আর তাতে কৃষকের লাভ কত।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের উদ্যোগে সম্প্রতি বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন খরচ, এদের খামারপ্রান্তের বিক্রয়মূল্য, লাভ ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা সম্পর্কে গবেষণা করা হয়েছে। এ গবেষণার একটি প্রধান অংশীদার প্রতিষ্ঠান ছিল বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। ওই ইনস্টিটিউটের কৃষি অর্থনীতি বিভাগ সমীক্ষা পরিচালনা করছে সবজির উৎপাদন খরচ ও এর লাভ নিয়ে। তারা যে তথ্য উপস্থাপন করেছে, তাতে দেখা যায়- সবজির উৎপাদন লাভজনক। কিন্তু খামারপ্রান্তে এর লাভ কম। কারণ এখানে যানবাহন ও বাজারজাতকরণ খরচ, মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফা এবং পচনশীলতার আর্থিক ক্ষতি যোগ করে নির্ধারণ করা হয় বিক্রয়মূল্য। সবজি পচনশীল পণ্য। এর পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ। সে কারণে খুচরা পর্যায়ে সবজির দাম খামারপ্রান্ত থেকে অনেক বেশি। ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিগুণ কিংবা এর চেয়েও বেশি হয়ে থাকে।
গত তিন বছর ধরে পেঁয়াজের উচ্চমূল্যে ভোক্তারা নাকাল হয়েছেন। এর উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি প্রায় ২০ টাকা। খামারপ্রান্তে এর গড় মূল্য ২৭ টাকা। লাভ প্রায় ৭ টাকা প্রতি কেজি। খুচরা পর্যায়ে এর দাম হতে পারে ২৫ শতাংশ অপচয়সহ সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক যোগ করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হলে এর গড়মূল্য দাঁড়ায় ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি। এ অবস্থায় পেঁয়াজের দামে ধারাবাহিক উল্লম্ফন উদ্বেগজনক। দুই বছর আগে আলুর উচ্চ মূল্যের বিষয়টিও এখানে উল্লেখযোগ্য। এটি ব্যবস্থাপনা সমস্যা। এতে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারসাজি আছে। এই সিন্ডিকেটকে অকার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ ছিল অপর্যাপ্ত। যে কারণে সংকট প্রলম্বিত হয়। এখন আবার পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে অবাধ আমদানির কারণে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের খামারপ্রান্তের মূল্য কমে গেছে। তাতে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
রসুন বাজারজাতকরণেও ব্যবস্থাপনার সমস্যা দৃশ্যমান। পেঁয়াজ ও রসুন মসলা-জাতীয় ফসল। এগুলো সবজিরও অন্তর্ভুক্ত। চাহিদার তুলনায় কম উৎপাদন, আমদানির অনিশ্চয়তা ও বাজারে সরবরাহ-সংকটের কারণে এ দুটো পণ্যের দাম অনেক সময় হয়ে পড়ে আকাশচুম্বী। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি ও দক্ষ ব্যবস্থাপনাই সংকট উত্তরণের প্রধান উপায়। এ বছর অবশ্য পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে। দামও স্থিতিশীল।
বাংলাদেশে প্রায় ৯৫ ধরনের সবজির চাষ হয়। প্রধান সবজির সংখ্যা ৩০ থেকে ৩৫টি। মোট উৎপাদন এলাকা শূন্য দশমিক ৯২ মিলিয়ন হেক্টর। তাতে বছরে উৎপাদন হয় ১৯ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন টন সবজি। জনপ্রতি দৈনিক সবজি গ্রহণের পরিমাণ প্রায় ৭০ গ্রাম। বিশ্বের অন্যান্য দেশে জনপ্রতি সবজি গ্রহণের পরিমাণ অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ জাপানিরা দৈনিক ৩০০ গ্রাম এবং আমেরিকানরা ৪০০ গ্রাম সবজি ভক্ষণ করে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশে সবজি খাওয়ার পরিমাণ আরও অনেক বাড়ানোর সুযোগ আছে। তাতে চালসহ অন্যান্য দানাদার শস্যের ওপর আমাদের অতিমাত্রায় নির্ভরতা কমে আসবে। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ঘটবে। দূরীভূত হবে পুষ্টিহীনতা। এর জন্য সবজির উৎপাদন বাড়াতে হবে। অদূর ভবিষ্যতে আমদানি করা সবজি বীজের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে।
একসময় শীতকালীন মৌসুমেই সবজির উৎপাদন হতো বেশি। গ্রীষ্মকালে এর আবাদ ছিল কম। এখন দুটো মৌসুমেই বেড়েছে সবজির আবাদ। গ্রীষ্মকালীন টমেটো ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁয়াজ সম্পর্কে আমাদের দেশে ৩০ বছর আগেও তেমন বেশি ধারণা ছিল না। এখন তা বাস্তবে সম্ভব হচ্ছে। এটি কৃষি গবেষণার অবদান। শীতকালে এখন মোট উৎপাদনের প্রায় ৭০ শতাংশ সবজির উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। বাকি ৩০ শতাংশ সবজির উৎপাদন হচ্ছে গ্রীষ্মকালে। শীতকালীন সবজিগুলোর মধ্যে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, গাজর, লেটুস, পালংশাক, ব্রকলি, শালগম, টমেটো, মুলা, লাউ, বেগুন ও শিম অন্যতম। গ্রীষ্মকালীন সবজির মধ্যে আছে ঢ্যাঁড়শ, পটোল, মিষ্টিকুমড়া, কাকরোল, চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ডাঁটা, লালশাক, পুঁইশাক, করলা, শসা ইত্যাদি। কিছু সবজি সারা বছরই উৎপাদিত হয়। এগুলোর মধ্যে আছে বেগুন, কচু, পেঁপে, কাঁচকলা, শজিনা ইত্যাদি।
বাংলাদেশ বর্তমানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সবজি রপ্তানি করছে বিদেশে। দিন দিন এর পরিমাণ ও আয় বাড়ছে। ১৯৯৩-৯৪ সালে সবজি রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৪২২ টন। আয় হয়েছিল ৯ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর ১৫ বছর পর ২০০৮-০৯ সালে সবজি রপ্তানি হয়েছে ২২ হাজার ৭ শত ৯১ টন। আয় হয় ৪৪ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি করা হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার ৫৪৫ টন সবজি। তাতে আয় হয়েছে প্রায় ১১৮ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিশ্বের ৩৫টি দেশে বর্তমানে বাংলাদেশের ফল ও সবজি রপ্তানি হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশ হলো- যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইতালিসহ আরও ২৮টি দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় শাকসবজির উৎপাদন ব্যয়বহুল। সে তুলনায় বাংলাদেশ থেকে সবজির আমদানি সুবিধাজনক। এতে বোঝা যায়, বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের সবজি রপ্তানি সম্প্রসারণের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। তবে এর জন্য বিদেশি বাজার-চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে মানসম্মত সবজির নিরন্তর সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার। সে লক্ষ্যে দরকার ভালো মানের সবজি উৎপাদন। চাই সংগ্রহ-উত্তর যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ।
এ ছাড়া বিদেশে সবজি পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত বিমান ও কার্গো স্পেস নিশ্চিতকরণের সঙ্গে এর ভাড়া হ্রাস করাও সবজি রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। সর্বোপরি যা প্রয়োজন, সেটি হলো বিদেশে বাংলাদেশি সবজির বাজার সম্প্রসারণের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা। সম্প্রতি বাংলাদেশে অর্গানিক সবজি আবাদ হচ্ছে। বিদেশে এগুলোর বেশ কদর আছে। দেশের অভ্যন্তরেও এর চাহিদা আছে। অতি সম্প্রতি ঢাকায় নিরাপদ সবজি বাজারজাতকরণের জন্য ফারমার্স মার্কেট চালু করা হয়েছে। সেখানে অর্গানিক সবজির চাহিদা বাড়ছে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি মিশনগুলো এর বাজারজাতকরণে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। এ লক্ষ্যে বিদেশি বাজার ও পণ্যমূল্য সম্পর্কে আমাদের রপ্তানিকারকদের নিয়মিত অবহিত রাখা প্রয়োজন।
খাদ্য হিসেবে সবজির জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এর কারণ সবজির পুষ্টিমান সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ বিদ্যমান। সবজিতে আছে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’। আছে প্রোটিন। আছে ক্যালসিয়াম ও লৌহ। সবজি বিভিন্ন অনুপুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। এটি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। এর অভাবে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। দৈহিক বৃদ্ধি হয় ব্যাহত। ভিটামিন ‘এ’-র অভাবে রাতকানা, আয়োডিনের অভাবে গলগণ্ড এবং আয়রনের অভাবে রক্তশূন্যতা ইত্যাদির প্রতিকার হচ্ছে খাবার হিসেবে সবজি গ্রহণ। তা ছাড়া সবজি আমিষ জাতীয় খাদ্যের আত্তীকরণে সহায়ক। এটি পাচনতন্ত্রের কার্যকারিতাও বৃদ্ধি করে। সবজিতে চর্বি ও শর্করার হার কম থাকায় শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে তা অত্যন্ত সহায়ক। এতে কোলেস্টেরল তেমন না থাকায় হৃদরোগ বা উচ্চরক্তচাপজনিত শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি কম থাকে। সবজিতে কিছু ফাইটোকেমিক্যাল বিদ্যমান থাকায় টিউমারসহ অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে তা অত্যন্ত সহায়ক।
অপুষ্টির সমস্যা সমাধানে সবজি গ্রহণ খুবই কার্যকর। এর জন্য চাই নিরাপদ সবজি। উৎপাদন ব্যবস্থায় বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার সীমিত মাত্রার মধ্যে রাখতে হবে। সবজির জৈব চাষকে উৎসাহিত করতে হবে। সবজির ফুডভ্যালু চেইনকে সংক্রামক জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। সবজি ধোয়ার ক্ষেত্রে দূষিত পানির ব্যবহার পরিহার করতে হবে। কোল্ডস্টোরেজ এবং শীতল চেইন পরিবহনের সুবিধা বৃদ্ধি করে উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যন্ত নিরাপদ সবজি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ভোক্তাদের জন্য মানসম্পন্ন সবজি সরবরাহ করতে উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের পরিবেশ উন্নত করতে হবে।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাক-সবজির চুক্তিভিত্তিক চাষ হচ্ছে। অনেক শিক্ষিত তরুণ এগিয়ে এসেছে সবজি চাষে। তারা উপযুক্ত মূল্যে বিক্রি করছে উৎপাদিত সবজি। এগুলো দেশের বড় বড় সুপার মার্কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিক্রির জন্য। বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়াকে নীতি ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে উৎসাহিত করতে হবে। তাতে মানসম্মত সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, রপ্তানি আয় বাড়বে। দেশের ভোক্তারাও ন্যায়সংগত মূল্যে সবজি ক্রয় করতে পারবে। তাতে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতসহ উপাদেয় সবজি গ্রহণ সম্ভব হবে। দূর হবে আমাদের পুষ্টি সমস্যা-
…