মনোযোগ ও নিষ্ঠায় পরিপূর্ণ একটি ফরজ নামাজ শেষে যখন মুমিন দুনিয়ার দিকে ফিরে বলে ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ’, এরপরই তার জবান থেকে যে শব্দ দুটি সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয়, তা হলো- ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ ও ‘আল্লাহু আকবার’।
একটি প্রশ্ন জাগে- এত সুন্দর ও পবিত্র একটি ইবাদত শেষ করেও কেন আমরা ক্ষমা চাই? আর কেনই বা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিই? এই প্রশ্নের জবাবই আজকের আলোচনার মূল বিষয়।
১. ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’: ইবাদতের পরও ক্ষমা প্রার্থনার রহস্য
নামাজ শেষে তিনবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলা একজন মুমিনের আত্মজ্ঞান, বিনয় ও সত্যনিষ্ঠার প্রতিচ্ছবি। এটি মূলত ইবাদতের অপূর্ণতার স্বীকৃতি। নামাজে মনোযোগ ও খুশু ধরে রাখা সবসময় সহজ নয়। কখনো মনোযোগ অন্যদিকে চলে যায়, কখনো হৃদয়ে অহংকারের ক্ষীণ ছায়া পড়ে। তাই নামাজ শেষে ইস্তিগফার উচ্চারণ আসলে সেই সব ত্রুটির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিনয়ী স্বীকারোক্তি। এটি যেন এক অন্তরনিবেদিত প্রার্থনা- ‘হে প্রভু! আমার এই ইবাদত তোমার মহিমার তুলনায় কিছুই নয়। তুমি এটি কবুল করো এবং এর ত্রুটিগুলো তোমার রহমতে ঢেকে দাও।’
এছাড়াও এই ইস্তিগফার অহংকার থেকে আত্মাকে রক্ষা করে। ইবাদতের পর আত্মতুষ্টি বা অহংকারের বীজ যেন জন্ম না নেয়, সেজন্যই ইস্তিগফার এক আধ্যাত্মিক ঢাল হিসেবে কাজ করে। এটি মানুষকে বিনম্র রাখে এবং আল্লাহর নিকটবর্তী করে।
সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো, এটি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবনের সরাসরি অনুকরণ। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর শপথ! নিশ্চয়ই আমি দিনে সত্তর বারেরও বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই ও তাওবা করি।’ (সহিহ বুখারি: ৬৩০৭)। সুনানে আবু দাউদে এসেছে, নামাজ শেষে নবীজি (স.) তিনবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলতেন (সুনান আবু দাউদ: ১৫১)। তাই এটি তাঁর গভীর বিনয় এবং আমাদের জন্য এক পরম অনুসরণীয় শিক্ষা।
২. ‘আল্লাহু আকবার’: শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা ও কৃতজ্ঞতার প্রকাশ
সালাম ফিরিয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলার অর্থ হলো- নামাজ শেষ হলেও আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ধারাবাহিকতা বজায় থাকা। এই মহান বাক্য তাওহিদের জীবন্ত স্বীকৃতি। নামাজ শুরু হয়েছিল ‘আল্লাহু আকবার’ দিয়ে; নামাজ শেষে আবারও একই বাক্য উচ্চারণ যেন ঘোষণা দেয়- ‘হে আল্লাহ! এখন আমি দুনিয়ার কাজে ফিরছি বটে, কিন্তু জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ।’
নামাজের তাওফিক দান করায় আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নিঃশব্দ মাধ্যমও এই ‘আল্লাহু আকবার’। যেন বলা হচ্ছে- ‘মহান আল্লাহ! তুমি আমাকে আবারও তোমার দরবারে দাঁড়ানোর সুযোগ দিলে, সমস্ত প্রশংসা শুধু তোমারই।’ নামাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর স্মরণের এই ধারাবাহিকতা মুমিনের জীবনে তাওহিদের চেতনাকে সদাজাগ্রত রাখে। সালামের পরের এই জিকির যেন বলে- ‘জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই তোমারই বড়ত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক।’
নামাজ শেষে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ ও ‘আল্লাহু আকবার’ বলা নিছক কোনো রীতি নয়; বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ঈমানদীপ্ত জীবনদর্শনের প্রতিফলন। আমরা যত বড় ইবাদতই করি না কেন, আমরা সর্বদা আল্লাহর মুখাপেক্ষী ও তাঁর ক্ষমার প্রার্থী। আর আমাদের জীবন-মরণ, প্রবেশ ও প্রস্থান সবই যেন ‘আল্লাহু আকবার’-এর ধারাবাহিক প্রতিধ্বনি হয়ে থাকে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নামাজের পর এই সুন্নতগুলো নিয়মিত আমল করার তাওফিক দান করুন এবং আমাদের ইবাদতসমূহ কবুল করুন। আমিন।
সিএনআই/২৫