আজমল হোসেন জুয়েল, বিশেষ প্রতিনিধি :: বঙ্গোপসাগরের চট্রগ্রাম অংশসহ দেশের বিভিন্ন নদ নদীতে সয়াবিন সিড (সয়াবিন তেলের কাচামাল) বোঝাই ৫৬টি ব্যক্তিমালিকানাধীন লাইটার জাহাজ নোঙর করা রয়েছে । আনলোডিং পয়েন্ট সম্পূর্ণ ফ্রি ক্লিয়ারেন্স থাকা সত্বেও মাসের পর মাস এ সমস্ত লাইটার জাহাজ খালাস করছে না আমদানিকারক। এখানে এমনও জাহাজ রয়েছে, যেগুলো থেকে দুই মাসের ও বেশি সময় ধরে পণ্য খালাস করেনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। ফলে চলতি রমজানে ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
লাইটার জাহাজ মনিটরিং সংস্থা বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেলের (বিডব্লিউটিসিসি) তথ্য অনুযায়ী, এসব লাইটার জাহাজে প্রায় ৯০ হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন সিড রয়েছে। জাহাজগুলো বর্তমানে চট্রগ্রামের কুতুবদিয়া, পতেঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন নদী বন্দরে নোঙর করে রাখা হয়েছে। তবে এ হিসাবের বাইরে আরও ২০-৩০ টি সয়াবিন বোঝাই লাইটারের সন্ধান পাওয়া গেছে।
জাহাজ মালিক, আমদানিকারক, রপ্তানিকারক ও এজেন্টদের মধ্যে লাইটার জাহাজ বরাদ্দের সমন্বয়কারী এই সেল নিশ্চিত করেছে যে, পণ্যবাহী জাহাজগুলো একাধিক আমদানিকারকের মালামাল বহন করছে। তবে শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পণ্য খালাসে দেরি হওয়ায় সরবরাহ সংকট আরও প্রকট হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন, এভাবে খালাস আটকে রাখার ফলে ভোজ্যতেল উৎপাদনের কাঁচামালের সংকট ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে, যার ফলে বাজারে দামও বেড়েছে। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) অভিযোগ করেছে, কিছু ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ ও দাম বাড়ানোর উদ্দেশ্যে জাহাজগুলোকে 'ভাসমান গুদাম' হিসেবে ব্যবহার করছে
ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, "লাইটার জাহাজে এভাবে সয়াবিন সিড ফেলে রাখার ফলে বাজারে সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। তিনি এর পেছনে সিন্ডিকেট রয়েছে অভিযোগ করে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানান।
কেবল বিশ্বাস গ্রুপেরই সয়াবিন সিড বোঝাই ৪৪টি লাইটারেজ জাহাজ বিভিন্ন নদীবন্দরে ভাসছে। এছাড়া প্রায় আধা ডজন আমদানিকারকের ১২টি লাইটার জাহাজও—দাউদকান্দি ঘাট, তৈলব ঘাট, মেঘনা ঘাট ও পটুয়াখালী ঘাটে সয়াবিন সিড নিয়ে ভাসছে। এরমধ্যে কেবিসি গ্রুপের লাইটার ও রয়েছে।
এই দেরির কারণে লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারীদের আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে। লাইটার জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এবং বিডব্লিউটিসিসির কনভেনর সাঈদ মাহমুদ বলেন, স্বাভাবিক নিয়মে জাহাজগুলো পণ্য পরিবহন করলে যে ভাড়া পেত, এভাবে আটকে থাকায় প্রতিটি জাহাজে ১০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত লোকসান হচ্ছে।
অথচ স্বাভাবিক অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য নিয়ে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য নৌঘাটে আনলোড করতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগার কথা নয়।এছাড়া অনেক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব লাইটার জাহাজ থাকায় কোন প্রকার ডাবল ট্রিপ (বিলম্ব মাশুল) ছাড়াই মাসের পর মাস মাঝ নদীতেই ভাসিয়ে রাখছে জাহাজ।
খালাসের দেরির বিষয়ে বিশ্বাস গ্রুপের সুপারভাইজার মো. রুবেল বলেন, "গত মাসে সয়াবিন সিড নিয়ে ৮টি জাহাজ আসে। এর প্রতিটিতে ২০ থেকে ৪০ হাজার টন করে পণ্য ছিল। এসব জাহাজ থেকে পণ্য আনলোড করার জন্য আমাদের চাহিদামতো লাইটার জাহাজ বরাদ্দ দেয়নি বিডব্লিউটিসিসি।
তিনি বলেন, "আমরা ৩ হাজার টন সক্ষমতার লাইটার জাহাজ চেয়েছিলাম, কিন্তু তারা এক হাজার টন সক্ষমতার জাহাজ বরাদ্দ দিয়েছে। যার ফলে নারায়ণগঞ্জ ঘাটে জাহাজজট দেখা দেয় এবং খালাসে দেরি হচ্ছে। যদিও পণ্যগুলো তিন দিন থেকে এক সপ্তাহের মধ্যেই আনলোড হওয়ার কথা।"
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিকে গ্রুপের পরিচালক (কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স) জাফর আলম দাবি করেন, লাইটার জাহাজ থেকে সয়াবিন সিডের খালাস আটকে থাকার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবিরের মতে, সয়াবিন সিড ছাড়াও গম এবং ডালবাহী আরও ৩২৫টি ব্যক্তিমালিকানাধীন লাইটার জাহাজ পণ্য নিয়ে বিভিন্ন নৌঘাটে খালাসের অপেক্ষায় আছে।
তিনি বলেন, "কিছু কিছু আমদানিকারক নিজস্ব গুদাম না থাকা সত্ত্বেও পণ্য আমদানি করেন। এসব পণ্য লাইটার জাহাজেই রেখে দেন তারা। এর ফলে বাজারে পণ্য সরবরাহ এবং জাহাজ উভয়েরই সংকট তৈরি হয়।"
বিডব্লিউটিসিসির নির্বাহী পরিচালক মেজর (অব.) জি এম খান বলেন, "লাইটার জাহাজের মাধ্যমে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে বিভিন্ন আমদানিকারকের সয়াবিন সিড এসেছে ৩ লাখ ৪ হাজার মেট্রিক টন। লাইটার জাহাজের মাধ্যমে সেগুলো বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।"
তবে পণ্য খালাসে দেরির কারণে বাজারের সরবরাহ প্রভাবিত হতে পারে।
দেশের ভোজ্যতেল চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানির পাশাপাশি সয়াবিন সিড আমদানির ওপরও নির্ভর করে। তবে সয়াবিন সিড থেকে প্রায় ২০ শতাংশ তেল পাওয়া যায়। বাকি ৮০ শতাংশ সয়ামিল পোলট্রি, গবাদি পশু ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আনলোডিং পয়েন্ট জট, কম সক্ষমতার লাইটার বরাদ্দ, লাইটার সংকটসহ সুক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে পণ্যের ঘাটতি এবং বাজার দরের অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে মত দিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে আসন্ন পবিত্র ঈদ উল ফিতরে বাজার দর নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে মত তাদের।