৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কিছুটা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে দিল্লির দাবি, দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বলছে, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সইয়ের মাধ্যমে ভারতকে প্রকৃত বন্ধুত্বের প্রমাণ দিতে হবে।
সম্প্রতি ওমানের রাজধানী মাস্কটে ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের মধ্যে এক সংক্ষিপ্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে তিস্তা চুক্তি দ্রুত সম্পন্ন করে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন তৌহিদ হোসেন।
তিস্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক চাপ
ঢাকার কূটনৈতিক মহল মনে করছে, দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। মাস্কটের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তিস্তার জট খোলা খুব কঠিন কিছু নয়। এটি হলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে ইতিবাচক বার্তা যাবে।
একজন কূটনীতিকের ভাষায়, "বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কোনো নির্দিষ্ট সরকারকেন্দ্রিক হওয়া উচিত নয়। ভারত যদি সত্যিই সুসম্পর্ক চায়, তাহলে তাদের বড় কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে। তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন হলে দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে যাবে।"
দিল্লি-কলকাতা দ্বন্দ্ব ও তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যৎ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, তিস্তা নিয়ে দিল্লি ও কলকাতা একে অপরের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। তার মতে, "কলকাতা বলছে দিল্লি, দিল্লি বলছে কলকাতা—এটা পুরোপুরি রাজনৈতিক খেলা। কেউ-ই সমস্যার সমাধান করতে চায় না। নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে, কারণ বছরের পর বছর আশ্বাসে থেকে বাংলাদেশ কোনো লাভবান হচ্ছে না।"
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের সব প্রস্তুতি নেওয়া হলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তা আটকে যায়। পরবর্তীতে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারও মমতাকে রাজি করাতে পারেনি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওঠানামা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্কে কিছুটা অস্বস্তি দেখা দেয়। বিশেষ করে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ এবং কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়।
যদিও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের পর কিছুটা শীতলতা আসে, তবে সীমান্ত ইস্যু ও শেখ হাসিনার বক্তব্য ঘিরে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়। এক পর্যায়ে ঢাকা-দিল্লি একে অপরের কূটনীতিকদের তলব করে।
এমন টানাপোড়েনের মধ্যেই মাস্কটে বৈঠক করেন তৌহিদ-জয়শঙ্কর। বৈঠকে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি ভাঙার প্রসঙ্গ তোলেন। এ বিষয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, "বাংলাদেশে একটি অভ্যুত্থান হয়েছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এমন ঘটনা অনেক দেশেই ঘটে।"
বিমসটেক সম্মেলনে মোদি-ইউনূস বৈঠকের সম্ভাবনা
বৈঠকে সীমান্ত হত্যা নিয়েও আলোচনা হয়। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা সীমান্ত হত্যা চায় না। পাশাপাশি, আগামী এপ্রিলে ব্যাংককে অনুষ্ঠেয় বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক আয়োজনের সম্ভাবনা নিয়েও কথা হয়েছে।
তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যৎ কোন পথে?
তিস্তা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশে জনমনে দীর্ঘদিন ধরে হতাশা বিরাজ করছে। সম্প্রতি এই ইস্যুতে তিস্তা নদীতে নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। বিএনপিও তিস্তা ইস্যুতে বেশ সরব। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, "ভারত যদি তিস্তা চুক্তিতে অনীহা দেখায়, তাহলে আমাদেরই বিকল্প পথ খুঁজে নিতে হবে।"
পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তিস্তা ইস্যুতে ভারত যদি আর সময়ক্ষেপণ করে, তাহলে দুই দেশের সম্পর্কে আরও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এখন দেখার বিষয়, বিমসটেক সম্মেলনে মোদি-ইউনূস বৈঠকে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনো অগ্রগতি হয় কি না।