একসময় প্রচলিত প্রবাদ ছিল— "মাঘের শীতে বাঘ পালায়", যা বোঝাত মাঘ মাসের তীব্র শীত। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের ঋতুচক্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। শীতকাল সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে, শীতের তীব্রতা কমে গেছে, আর বছরের অধিকাংশ সময়ই তাপমাত্রা বেশি থাকছে।
শীতের সংক্ষিপ্ততা ও তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতি
বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, পৌষ ও মাঘ মাস শীতকাল হিসেবে ধরা হয়। ৫-১০ বছর আগেও এই সময় ঘন কুয়াশা, লম্বা শৈত্যপ্রবাহ এবং উত্তরবঙ্গে ৫-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা দেখা যেত। এখন সেই দৃশ্য প্রায় বিলুপ্ত। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, গত কয়েক বছরে শীতের স্থায়িত্ব কমে এসেছে, এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও তুলনামূলকভাবে বেশি থাকছে।
২০২৪ সাল ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ বছর। বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। বাংলাদেশেও তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রায় প্রতিটি মাসেই গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি ছিল।
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা (২০২৪):
জানুয়ারি: ২৫.২°C
এপ্রিল: ৩৩.২°C
জুলাই: ৩১.১°C
ডিসেম্বর: ২৬.৪°C
সর্বনিম্ন তাপমাত্রা (২০২৪):
জানুয়ারি: ১২.৫°C
এপ্রিল: ২৩.১°C
আগস্ট: ২৫.৭°C
ডিসেম্বর: ১৪.২°C
এই পরিসংখ্যান দেখায়, বাংলাদেশের শীতকাল আগের মতো শীতল থাকছে না, বরং বেশ উষ্ণ হয়ে উঠছে।
বর্ধিত তাপমাত্রার প্রভাব ও আশঙ্কা
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (WMO) এবং নাসার তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে বিশ্বের প্রায় ৪৪% অঞ্চল চরম তাপমাত্রার শিকার হয়েছে, আর ২২ জুলাই ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ দিন। বাংলাদেশেও ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ২৬ দিনের তাপপ্রবাহ রেকর্ড হয়েছিল, যার ফলে হিটস্ট্রোকে প্রায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন, ২০২৫ সালেও একই প্রবণতা বজায় থাকবে এবং তাপপ্রবাহ আরও দীর্ঘ হতে পারে।
ঢাকায় ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা
গত ৭ বছরে রাজধানী ঢাকার গড় তাপমাত্রা ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (DSCC):
২০১৭: ৩৩.৫০°C
২০২৪: ৩৬.৫৪°C
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (DNCC):
২০১৭: ৩৩.৩৯°C
২০২৪: ৩৭.৩৮°C
মতিঝিলে তাপমাত্রা ৩৫.৫০°C থেকে বেড়ে ৩৯.১°C হয়েছে, গুলিস্তানে ৩৪°C থেকে ৪০.৮°C হয়েছে।
সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা:
মহাখালী: ২০১৭ সালে ৩৩.৫০°C → ২০২৪ সালে ৪১.৫°C (৭ বছর ব্যবধানে ৭.৫°C বৃদ্ধি!)
তেজগাঁও, মিরপুর, ফার্মগেট: তাপমাত্রা বেড়েছে সাড়ে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।
কেন বাড়ছে তাপমাত্রা?
1. জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা:
জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার
গ্রিনহাউস গ্যাসের বৃদ্ধি
2. পরিবেশগত বিপর্যয়:
বনভূমি ধ্বংস
জলাশয়, খাল-বিল ভরাট
অপরিকল্পিত নগরায়ণ
3. প্রাকৃতিক দুর্যোগের বৃদ্ধি:
অনিয়মিত বর্ষণ
দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহ
বন্যা ও খরার প্রকোপ
সমাধান ও করণীয়
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এজন্য—
জলবায়ু-বান্ধব নীতি গ্রহণ:
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো
নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো
শিল্প-কারখানার কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ
পরিবেশ রক্ষা:
বনভূমি সংরক্ষণ ও পুনঃবনায়ন
জলাশয় ও খাল-বিল পুনরুদ্ধার
সবুজায়ন ও ছাদবাগান প্রচার
সচেতনতা বৃদ্ধি:
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে জনসচেতনতা বৃদ্ধি
তাপপ্রবাহ প্রতিরোধে পূর্বাভাস ও সতর্কতা ব্যবস্থা জোরদার
বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। শীতকাল ছোট হয়ে আসছে, গ্রীষ্মকাল দীর্ঘ হচ্ছে, এবং অতিরিক্ত তাপমাত্রা মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ভবিষ্যতে এই পরিবর্তন আরও মারাত্মক হতে পারে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পরিবেশগত সংকট আরও ঘনীভূত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দ্রুত ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।