বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে আলু চাষ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। একসময় আলু শুধু তরকারির একটি উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতো, কিন্তু বর্তমানে এটি খাদ্যশৃঙ্খলে একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করছে। স্বাদ ও পুষ্টিগুণের কারণে আলু আজ শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী অন্যতম প্রধান ফসল হিসেবে স্বীকৃত।
আলু চাষে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আলু উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে রয়েছে। মাটির উর্বরতা, অনুকূল আবহাওয়া এবং উন্নত চাষপ্রযুক্তির কারণে দেশে আলুর উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে প্রচলিত চাষ পদ্ধতি ও অত্যধিক রাসায়নিক সারের ব্যবহারের ফলে মাটির গুণাগুণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষিতত্ত্ব বিভাগের একদল গবেষক কাজ করছেন। তারা সংরক্ষণশীল চাষ পদ্ধতি (কনজারভেশন এগ্রিকালচার) বা বিনা চাষে (জিরো টিলেজ) আলু উৎপাদনের মাধ্যমে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করেছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিনা চাষ পদ্ধতিতে আলুর ফলন প্রচলিত চাষ পদ্ধতির তুলনায় বেশি। এছাড়া, এই পদ্ধতিতে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বলে গবেষকরা আশাবাদী।
দুই মৌসুম ধরে আলুর চাষ পদ্ধতি ও সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্থাপনা (ইন্টিগ্রেটেড নিউট্রিয়েন্ট ম্যানেজমেন্ট বা আইএনএম) নিয়ে গবেষণা চালিয়ে তারা এই সাফল্য অর্জন করেছেন। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এই গবেষণা প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
গত ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব খামার গবেষণাগারে আয়োজিত মাঠ গবেষণা কার্যক্রম পরিদর্শনের সময় গবেষণার বিস্তারিত তথ্য জানানো হয়। গবেষক দলের প্রধান কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ খায়রুল হাসান এবং সহযোগী গবেষক পিএইচডি ফেলো এফ. এম. রুহুল কুদ্দুস গবেষণার অগ্রগতি ও ফলাফল উপস্থাপন করেন।
এ সময় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাকৃবি রিসার্চ সিস্টেমের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাম্মাদুর রহমান। এছাড়াও কৃষিতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. রমিজ উদ্দিন, অধ্যাপক ড. মো. আবদুল কাদের, অধ্যাপক ড. মো. আবদুস সালাম, অধ্যাপক ড. মো. পারভেজ আনোয়ারসহ বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান গবেষক ড. খায়রুল হাসান গবেষণার কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, "আমরা বারি-৭ (ডায়মন্ড) জাতের আলু নিয়ে গবেষণা চালিয়েছি। এই গবেষণায় দুই ধরনের চাষ পদ্ধতি নিয়ে কাজ করা হয়েছে—একটি প্রচলিত চাষ পদ্ধতি এবং অন্যটি সংরক্ষণশীল চাষ বা বিনা চাষ (জিরো টিলেজ) পদ্ধতি। পাশাপাশি সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্থাপনা (আইএনএম) নিয়েও গবেষণা করা হয়েছে। আইএনএম পদ্ধতিতে ৫ ধরনের সারের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।"
তিনি আরও জানান, "গবেষণার প্রথম মৌসুমে আলুর চাষ পদ্ধতি ও সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে একই জমিতে তিন পদ্ধতিতে আলু চাষ করা হয়েছে। প্রথমটিতে বিনা চাষ ও শতভাগ রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয়েছে, দ্বিতীয়টিতে প্রচলিত চাষ ও শতভাগ রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয়েছে এবং তৃতীয়টিতে বিনা চাষ ও শতভাগ জৈব সার প্রয়োগ করা হয়েছে। ফলাফলে দেখা গেছে, বিনা চাষ পদ্ধতি ও শতভাগ রাসায়নিক সার প্রয়োগকৃত অংশের ফলন প্রচলিত চাষ পদ্ধতির তুলনায় হেক্টরপ্রতি ২ টন বেশি। গবেষণার দ্বিতীয় মৌসুমের ফসল এখন মাঠে রয়েছে, তবে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে প্রথম মৌসুমের মতোই বিনা চাষ পদ্ধতিতে অধিক ফলন আশা করা হচ্ছে।"
সহযোগী গবেষক পিএইচডি ফেলো এফ. এম. রুহুল কুদ্দুস বলেন, "মাটি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, বিনা চাষ পদ্ধতি ও সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কেঁচো সার, মুরগির বিষ্ঠা ও গোবর সার প্রয়োগ করা জমিতে জৈব কার্বনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি। এই পদ্ধতি কার্বন নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করে। সংরক্ষণশীল কৃষিতে বিনা চাষ পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে চাষাবাদের খরচ কমে আসে। পাশাপাশি সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রাসায়নিক সারের ব্যবহারেও সাশ্রয় হয়, যা কৃষকদের আর্থিকভাবে লাভবান করবে।"
এই গবেষণা বাংলাদেশের কৃষি খাতে একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব চাষ পদ্ধতির দিকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।