বাংলাদেশ পুরোনো কাপড় আমদানিকারক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনজুর আলম বলেন, ‘কিছুদিন আগে সারা দেশে ব্যাপক শীত পড়ায় পুরোনো কাপড়ের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়েছিল। তবে এখন শীতের তীব্রতা কমে যাওয়ায় সেই চাহিদা আর নেই। এ বছর এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার জটিলতা এবং ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে আমদানিকারকরা আশানুরূপ পরিমাণে পুরোনো কাপড় আমদানি করতে পারেননি।’
সরেজমিন দেখা গেছে, সড়কের পাশে পাতা চৌকিতে শীতের কাপড়ের স্তূপ জমে আছে। ক্রেতারা বেছে বেছে রংচটা পুরোনো কাপড় থেকে অপেক্ষাকৃত নতুন কাপড় কিনছেন। একজন ক্রেতা ১৫০ থেকে ২৫০ টাকায় পেয়ে যাচ্ছেন পছন্দের সোয়েটার, কোট, গেঞ্জি ইত্যাদি। নগরীর জলসা মার্কেট ও হকার্স মার্কেটকে স্থানীয়রা খুচরা কাপড় বিক্রির ‘গাঁইট মার্কেট’ হিসেবেই চেনেন। মূলত এখানে এসব কাপড় চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে আসে। খাতুনগঞ্জে রয়েছে শতাধিক পুরোনো কাপড়ের পাইকারি দোকান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নিলামে কেনা পুরোনো কাপড় চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে খাতুনগঞ্জের কয়েকটি মার্কেটে পৌঁছায়। এই কাপড়ের আমদানিকারক রয়েছেন প্রায় ৫০ জন। এই ব্যবসার সঙ্গে সারা দেশে প্রায় ১০ লাখ পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা জড়িত। খাতুনগঞ্জের আমির মার্কেটে প্রতি বেল সোয়েটার বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১১ হাজার টাকায়, জ্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৬ হাজার টাকায় এবং গেঞ্জির বেল ৭-৮ হাজার টাকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাধারণত এসব কাপড় জাপান, কোরিয়া ও তাইওয়ান থেকে আনা হয়। উন্নত দেশে ধোয়ার খরচ বেশি হওয়ায় অনেক সময় কাপড় দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা হয় না। সেখানকার ব্যবসায়ীরা ব্যবহৃত কাপড় কিনে অনুন্নত দেশগুলোতে বিক্রি করেন বেল হিসেবে। পাইকারিতে এসব কাপড় বিক্রি হয় কেজি দরে। তবে কাপড়গুলো দেখতে ফ্রেশ এবং ভালো মানের। সে হিসেবে কাপড়গুলোর দাম তুলনামূলকভাবে কম। শীতের কাপড়গুলোকে বাক্স আকারের প্যাকে ভর্তি করা হয়, যাকে বলা হয় ‘বেল’। স্থানীয়দের কাছে এই ‘বেল’ই ‘গাঁইট’ নামে পরিচিত।
খাতুনগঞ্জ আমির মার্কেটের মেসার্স ফারুক অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক কাজী জাকির হোসেন আনিছ জানান, সব অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা কাপড় কিনতে আসেন। কেউ আসতে না পারলে মোবাইলে অর্ডার দেন। রাস্তাঘাট ভালো হওয়ায় পণ্য পরিবহনে সুবিধা হয়েছে।
খাতুনগঞ্জের পুরাতন পোশাকের আড়ৎদার মেসার্স হাসেম অ্যান্ড ব্রাদার্সের নূর উদ্দিন বলেন, ‘আমরা কুরিয়ারের মাধ্যমে সারা দেশে বিক্রি করি। সারা দেশের খুচরা বিক্রেতারা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যান। এখানে বেলপ্রতি ৫ থেকে ১২ হাজার টাকা দামের মধ্যে গাঁইট পাওয়া যায়। আমরা জ্যাকেট, সোয়েটার, গেঞ্জি, টি-শার্ট, জিন্সসহ সব ধরনের শীতের পোশাক রেখেছি। আমরা দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যবসায়ী। প্রথম পর্যায় থেকে প্রতি বেলে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা লাভে বিক্রি করি।’
জানা গেছে, মূলত যেসব অঞ্চলে শীত বেশি, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য এসব পণ্য কিনে নিয়ে যান সেখানকার ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া সারা দেশ থেকেই ক্রেতারা এখানে আসেন। কারণ, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরাই মূলত পুরোনো কাপড় আমদানি করেন। এই ব্যবসায় আগ্রহী হলে থাকতে হবে আমদানির লাইসেন্স। সারা দেশে কোটা হিসেবে ৩ হাজার ব্যক্তিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। প্রতি লাইসেন্সের বিপরীতে ৫০ হাজার টাকার বেশি পণ্য আমদানি করা যায় না।
আমির মার্কেটের পাইকারি দোকানের বিক্রেতা আবদুল হালিম জানান, আগে একটি লাইসেন্সে ৬ টন করে কাপড় আনা যেত। এখন তা ৩ টন করা হয়েছে, এতে সমস্যা হচ্ছে।
পুরোনো কাপড় আমদানিকারক সমিতির সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ৯০০ কোটি টাকার কাপড় আমদানি হয়েছে, যা গত বছর ছিল ৮৫০ কোটি টাকা। ওই হিসেবে আমদানি বেড়েছে ৫০ কোটি টাকার। তবে চট্টগ্রাম বন্দরে জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানির তথ্যে দেখা যায়, এবার জাপান, তাইওয়ান, কোরিয়া, চীন থেকে ৭০২ টিইইউএস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একক কনটেইনার) পুরোনো কাপড় আমদানি হয়েছে। এতে প্রায় ১২ হাজার টন কাপড় ছিল। আরও সাড়ে চার টন কাপড় ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমদানি করার জন্য অনুমতি নেওয়া হয়েছে।
খাতুনগঞ্জের আমির মার্কেটের মেসার্স ফারুক অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক আহমদ নূর খান বলেন, ‘নভেম্বর থেকে এসব পুরোনো কাপড়ের বেল বিক্রি জমে ওঠার কথা। অথচ জানুয়ারি মাস শেষ করে এখন ফেব্রুয়ারি। এখনো আশানুরূপ ক্রেতার দেখা নেই। গত বছর প্রতিদিন ৪০-৪৫টি বেল বিক্রি হলেও এ বছর সেটা ১৫-২০টিতে নেমেছে।’
চট্টগ্রামের জহুর হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন বলেন, ‘চট্টগ্রামে শীত তেমন একটা নেই। শীত না থাকলেও আমরা নভেম্বর থেকে বেল সংগ্রহ করে ভালো মানের কাপড়গুলো দোকানে উঠিয়েছি। অল্পস্বল্প বিক্রি আছে। তবে গত বছরের তুলনায় বিক্রি নেই।’
নগরীর আগ্রাবাদ এলাকার ভাসমান হকার ফোরকান হোসেন বলেন, ‘আমরা কয়েকজন মিলে খাতুনগঞ্জের আমির মার্কেট থেকে বেলগুলো কিনি। এরপর সাইজ ও মানভেদে কাপড়গুলো বাছাই করে ভ্যানে বিক্রি করি। তবে এবার বিক্রি বেশি নেই। শীত বেশি পড়লে বিক্রি বাড়ে। কারণ, অধিকাংশ ক্রেতা নিম্ন আয়ের মানুষ। তারা শীত বাড়লে কেনে।’