১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয় এক গভীর শূন্যতা। সেই সময় খালেদা জিয়া ছিলেন দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে এক গৃহবধূর জীবনযাপন করা একজন নারী। জিয়াউর রহমানের মৃত্যু বিএনপিকে গভীর সংকটে ফেলে। দলটি বিপর্যস্ত ও নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে।
বিএনপির নেতৃত্ব সংকট
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলের নেতৃত্ব নিয়ে দেখা দেয় বিভক্তি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার, যাকে অনেকেই বৃদ্ধ এবং দুর্বল নেতা হিসেবে দেখতেন। দলের একটি অংশ নতুন নেতৃত্ব চাইলেও, সাত্তারের নেতৃত্বে সরকারে থাকা আরেকটি অংশ এর বিরোধিতা করে।
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল এইচ এম এরশাদ সাত্তারের নেতৃত্বে সন্তুষ্ট ছিলেন। তবে মওদুদ আহমদ তার বইতে উল্লেখ করেছেন যে, যদি খালেদা জিয়া প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে চাইতেন, তাহলে অন্য কারো প্রার্থিতা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ত।
খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসার গল্প
জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় থাকাকালে খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তিনি দুই সন্তান তারেক ও কোকোকে নিয়ে গৃহবধূর ভূমিকা পালন করছিলেন। কিন্তু বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্ব নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের অসন্তোষ এবং দলের সংকটময় অবস্থা তাকে রাজনীতিতে আসতে প্ররোচিত করে।
প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ উল্লেখ করেছেন, জিয়াউর রহমানের আকস্মিক মৃত্যু খালেদা জিয়ার মনে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করেছিল। তিনি রাজনীতিতে আসার বিষয়ে অনাগ্রহী ছিলেন, কারণ পরিবার থেকেও তাকে উৎসাহিত করা হয়নি। তবে বিএনপির তৎকালীন নেতারা, বিশেষত কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন, নুরুল ইসলাম শিশু এবং বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মতো নেতারা তাকে রাজনীতিতে আসার জন্য বোঝান।
রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ
১৯৮২ সালের ১৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। একই বছরের ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে বক্তব্য দিয়ে তিনি রাজনৈতিক মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর ধীরে ধীরে তিনি দলের অভ্যন্তরে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন।
নেতৃত্বে অভিষেক
১৯৮৩ সালে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দলের ভেতরে ভিন্ন মত থাকা সত্ত্বেও এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন
জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার নেতৃত্বে বিএনপি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র হয়ে ওঠে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয় এবং খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন।
২০০১-২০০৬: ক্ষমতা ও বিতর্ক
দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার সরকার একাধিক বিতর্কের মুখে পড়ে। ২০০৬ সালের পর বিএনপি রাজনীতিতে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়।
সাম্প্রতিক অবস্থা
দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালে খালেদা জিয়া কারাবন্দি হন। ২০২০ সালে তিনি সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পান, তবে রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে এবং বিদেশ না যেতে বাধ্য হন।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান ছিল এক সংগ্রামী যাত্রা। তৎকালীন সংকটময় পরিস্থিতি তাকে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নেত্রীতে পরিণত করে। তার রাজনৈতিক জীবন এখনো বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।