
ইউসুফ আজাদঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) একসময় ছিল এক তুমুল আলোচিত শক্তি। ১৯৯৮ সালে শান্তিচুক্তির পর জন্ম নেওয়া এই দলটি দ্রুতই পার্বত্য জনগোষ্ঠীর অধিকার, ভূমি প্রশ্ন এবং সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। তবে গত কয়েক বছর ধরে তাদের কার্যক্রম তুলনামূলক ম্লান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সাম্প্রতিক সময়ে ইউপিডিএফ আবারও আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে—কেন এই আকস্মিক পুনরুত্থান? এর রাজনৈতিক তাৎপর্য কতটা গভীর?
১. অসমাধানকৃত ক্ষোভ ও সাম্প্রতিক সহিংসতা
খাগড়াছড়ির গুইমারায় ধর্ষণের ঘটনার পর ইউপিডিএফের ডাকা অবরোধ এবং তার পরিণতিতে সংঘর্ষ ও রক্তপাত শুধু স্থানীয় ক্ষোভ নয়, বরং দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও অমীমাংসিত সংকটের বহিঃপ্রকাশ। ভূমি অধিকারের প্রশ্ন, নিরাপত্তা বাহিনীর দমননীতি, সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি—এসব ইস্যু এখনও অমীমাংসিত। ইউপিডিএফ সেই ক্ষোভকে রাজনৈতিক পরিসরে তুলে ধরছে। সরকারের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা আন্দোলনকে ‘অপরিপক্ব’ বললেও বাস্তবে এটি দীর্ঘদিনের দুঃখ-কষ্ট ও বঞ্চনার বহিঃপ্রকাশ।
২. সম্পর্কের টানাপোড়েন
১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পরও পার্বত্য অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি আসেনি। বরং সরকারের কেন্দ্রীয় নীতি এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশার মধ্যে ফারাক আজও বিদ্যমান। ইউপিডিএফ এক সময় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে; ২০১৯ সালের ঘটনায় কয়েকজন প্রাণ হারায়। এ ধরনের সংঘর্ষ দলটিকে দুর্বল করে তোলে। কিন্তু বর্তমানে, যখন জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনের আলোচনা চলছে—সংস্কার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন সামনে আসছে—তখন ইউপিডিএফ আবারও নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তুলতে চাইছে। এটি শুধু আঞ্চলিক রাজনীতির পুনরুত্থান নয়; বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্নকেও সামনে নিয়ে আসছে।
৩. মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব
আজকের রাজনীতিতে প্রচার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ইউপিডিএফকে ঘিরে সাম্প্রতিক সহিংসতা এবং আন্দোলনের খবর জাতীয় গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #UPDF এবং #ParbatyaChattogram ট্রেন্ড করছে। এর ফলে একটি স্থানীয় ইস্যু মুহূর্তেই জাতীয় আলোচনায় পরিণত হয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি দেখায়, আধুনিক রাজনীতিতে মিডিয়া কভারেজ ও অনলাইন আলোচনাই একটি দলকে আবার সামনে নিয়ে আসতে পারে।
৪. রাজনৈতিক তাৎপর্য
ইউপিডিএফের আকস্মিক আলোচনায় আসা আসলে আকস্মিক নয়। এটি শান্তিচুক্তি-পরবর্তী অসম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতির প্রতিক্রিয়া এবং পার্বত্য জনগণের বঞ্চনার পুনরুত্থান। সরকারের জন্য এখানে স্পষ্ট বার্তা আছে—এই ইস্যুগুলোকে দমনমূলকভাবে মোকাবিলা করলে কেবল সহিংসতা বাড়বে। সংলাপ, নীতি সংস্কার এবং প্রকৃত ক্ষমতায়ন ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়।
ইউপিডিএফের পুনরুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। এটি শুধু একটি আঞ্চলিক দলের পুনরায় আলোচনায় আসা নয়; বরং দেশের রাজনৈতিক কাঠামো, বিকেন্দ্রীকরণ এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ কতটা কার্যকর—তারও পরীক্ষা। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে যদি আবারও উপেক্ষা করা হয়, তাহলে তা শুধুমাত্র পাহাড় নয়, পুরো দেশের জন্য নতুন সংকট ডেকে আনতে পারে।
লেখকঃ রাজনৈতিক বিশ্লেষক